রেজোয়ান আহমেদ : দেশে ৬২টি মার্চেন্ট ব্যাংক থাকলেও ইস্যু আনতে পারছে হাতে গোনা কয়েকটি। অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংকই মার্জিণ ঋণ প্রদান ও পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। দক্ষ জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো ইস্যু আনতে পারছে না বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন কম হওয়াকেও কারন হিসাবে মনে করছেন তারা।
২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪১টি মার্চেন্ট ব্যাংক (ইস্যু ম্যানেজার) শেয়ারবাজারে ৯৯টি ইস্যু (কোম্পানি) এনেছে। এরমধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংক অন্যের সঙ্গে যৌথ হিসেবে শুধুমাত্র নাম ব্যবহার করেছে। যে কারনে প্রকৃত ইস্যু আনার কাজ করা মার্চেন্ট ব্যাংকের সংখ্যা ৪১ এর চেয়ে অনেক কম হবে। এসময় সবচেয়ে বেশি ১৫টি (যৌথভাবেসহ) ইস্যু এনেছে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। তবে অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংক এনেছে ১টি ও ২টি করে। যারা আইপিওতে নিজেদের নাম ব্যবহার ছাড়া কোন দায়িত্ব পালন করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকারদের সক্ষমতা ও পেশাগত জ্ঞানের দরকার। এক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে একটি শক্তিশালী পেশাদার টিম থাকা দরকার। তবে একটি দক্ষ টিম গঠনে ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধস নতুন মার্চেন্ট ব্যাংকের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যাতে পুরাতন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ইস্যু আনার ক্ষেত্রে এগিয়ে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, সক্ষমতা ও পেশাগত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ইস্যু আনা। এক্ষেত্রে যাদের সক্ষমতা ও পেশাগত জ্ঞান ভালো, তারা ইস্যু আনছে, আর বাকিরা পারছে না। যারা আনছে না, তারা মার্জিন ঋণে সন্তুষ্ট থাকতে পারে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক নির্দেশনা বলা হয়েছে, প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংককে প্রতি ২ বছরে আইপিওর জন্য অন্তত্ব ১টি ফাইল দাখিল করতে হবে। অন্যথায় মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল করার বিধান রয়েছে।
প্রতি ২ বছরে ১টি ফাইল দাখিল করার বিধান থাকলেও সে হারে আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয় না। যাতে অনেক মার্চেন্ট ব্যাংক আইপিও নিয়ে কাজ করতে অনীহা। কারন বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ি প্রতি বছরে ফাইল জমা পড়বে কমপক্ষে ৩১টি। কিন্তু গত ৯ বছরে গড়ে আইপিও অনুমোদন দেয়া হয়েছে ১১টি করে। তাহলে এতো এতো ফাইল জমা দিয়ে লাভ কি হবে? বরং একদিকে মার্চেন্ট ব্যাংকের শ্রম ব্যয় হবে এবং অন্যদিকে আইপিওতে আসতে চাওয়া কোম্পানির ব্যয় হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন ঝুকিঁর মধ্যে পড়বে।
এএফসি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহি মাহবুব এইচ মজুমদার বিজনেস আওয়ারকে বলেন, একটি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনা সৃজনশীল কাজ। এক্ষেত্রে পেশাদার টিম লাগে। যাদের এই টিম আছে, তারা ইস্যু আনছে। আর যাদের নেই, তারা পারছে না।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪১টি ইস্যু ম্যানেজার ৯৯টি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে এনেছে। এরমধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ১০টি কোম্পানি।
নিম্নে ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা তুলে ধরা হল:
সাল | ফিক্সড প্রাইস মেথড | বুক বিল্ডিং মেথড | মোট |
২০১১ | ৫টি | ২টি | ৭টি |
২০১২ | ১১টি | ১১টি | |
২০১৩ | ১৪টি | ১৪টি | |
২০১৪ | ১৭টি | ১৭টি | |
২০১৫ | ১৩টি | ১টি | ১৪টি |
২০১৬ | ৬টি | ১টি | ৭টি |
২০১৭ | ৬টি | ১টি | ৭টি |
২০১৮ | ৯টি | ২টি | ১১টি |
২০১৯ | ৭টি | ২টি | ৯টি |
২০২০ | ১টি | ১টি | ২টি |
মোট | ৮৯টি | ১০টি | ৯৯টি |
সন্ধানি লাইফ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজুরুল ইসলাম (এফসিএমএ) বিজনেস আওয়ারকে বলেন, ইস্যু বেশি আনার ক্ষেত্রে প্রফেশনাল টিম থাকা অন্যতম কারন। আইসিবি ক্যাপিটাল একটি পুরাতন প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিনে এই প্রতিষ্ঠানে প্রফেশনাল টিম গড়ে উঠেছে। যাতে ইস্যু বেশি আনতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া ইস্যু আনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সারির মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোতেও প্রফেশনাল টিম রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ২০১০ সালের শেয়ারবাজারে ধসের কারনে অনেক মার্চেন্ট ব্যাংক প্রফেশনাল টিম গঠন করতে পারেনি। কারন ব্যয় বাড়ার ভয়ে টিম গঠনের সাহস করতে পারেনি।
সবচেয়ে বেশি ইস্যু আনা আইসিবি ক্যাপিটালের ১৫টির পরে রয়েছে ইমপেরিয়াল ক্যাপিটাল। প্রতিষ্ঠানটি ১২টি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে এনেছে। এরপরে এএফসি ক্যাপিটাল ১১টি, লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টস ১০টি, ব্যানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট ৯টি, অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ও প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজম্যান্ট ৭টি করে, আইডিএলসি ইনভেষ্টমেন্টস, এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও আলফা ক্যাপিটাল ৬টি করে এবং সিএপিএম অ্যাডভাইজরি ৫টি ইস্যু এনেছে।
এছাড়া সিটিজেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট ৪টি, জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট, বিএমএসএল ইনভেষ্টমেন্ট, এমটিবি ক্যাপিটাল ও ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট ৩টি করে, ইউনিক্যাপ ইনভেস্টমেন্ট, ব্র্যাক ইপিএল ম্যানেজম্যান্ট, রয়েল গ্রীণ ক্যাপিটাল মার্কেট, পিএলএফএস ইনভেষ্টমেন্টস ও প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট ২টি করে ইস্যু এনেছে।
আর ১টি করে ইস্যু এনেছে গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজম্যান্ট, বিএলআই ক্যাপিটাল, আইআইডিএফসি ক্যাপিটাল, ইসি সিকিউরিটিজ, ট্রাস্ট ব্যাংক ইনভেষ্টমেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস, সোনালি ইনভেষ্টমেন্ট, সিগমা ক্যাপিটাল ম্যানেজম্যান্ট, বেটাওয়ান ইনভেষ্টমেন্টস, স্বদেশ ইনভেষ্টমেন্ট ম্যানেজম্যান্ট, ফাঁস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট, এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, এনবিএল ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট, রূপালি ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনারস ইনভেস্টমেন্ট, সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস, সন্ধানি লাইফ ফাইন্যান্স এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস।
কোন ইস্যু না আনা ইস্যু ম্যানেজারদের মধ্যে রয়েছেন- এবি ইনভেষ্টমেন্ট, এবিএসিআই ইনভেস্টমেন্ট, অগ্রণী ইকুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বিডি ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল হোল্ডিংস, বেঙ্গল ইনভেষ্টমেন্টস, কসমোপলিটন ফিন্যান্স লিমিটেড, এক্সিম ইসলামী ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, গ্রীণ ডেল্টা ক্যাপিটাল, জিএসপি ইনভেস্টমেন্ট, এইচএএল ক্যাপিটাল, আইএল ক্যাপিটাল, যমুনা ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, এনডিবি ক্যাপিটাল লিমিটেড, রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, রিভারস্টোন ক্যাপিটাল, রুটস ইনভেস্টমেন্ট, শাহজালাল ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট, উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, স্ট্যাটেজিক ফাইন্যান্স, মেঘনা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, সোনারবাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজম্যান্ট, মাইডাস ইনভেস্টমেন্ট, এআইবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজম্যান্ট ও ইসলামি ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট।
বিজনেস আওয়ার/২৫ আগস্ট, ২০২০/আরএ