ঢাকা , রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এগিয়ে যাচ্ছে শেয়ারবাজার

  • পোস্ট হয়েছে : ১০:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • 1

রেজোয়ান আহমেদ : করোনাভাইরাস মহামারিকে দূরে সড়িয়ে শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন। যা সহজ হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের আতঙ্ক দূর হওয়ায়। এছাড়া নতুন কমিশনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বড় আর্থিক জরিমানা ও কিছু কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাতিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়িয়েছে। আর ব্যাংকের সুদের হার তলানিতে নেমে আসায় শেয়ারবাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। যাতে করে শেয়ারবাজারে মূল্যসূচক, বাজার মূলধন ও আর্থিক লেনদেনে বড় উন্নতি হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে সেটা ভয়াবহ রূপ ধারন করে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে। এরপরই বিনিয়োগকারীরা যার যার অবস্থান থেকে শুধু বিক্রি করার চেষ্টাই করে গেছেন। বাজারে দেখা দেয় ক্রেতার ভয়াবহ সংকট। তবে এখন করোনাভাইরাস নিয়ে সেই আতঙ্ক নেই। এছাড়া নতুন কমিশনের কিছু পদক্ষেপ বাড়তি আস্থা যুগিয়েছে। যাতে করে শেয়ারবাজার এগিয়ে যাচ্ছে।

দেখা গেছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি ৪৭৬৮ পয়েন্টে ছিল। যেটা করোনা আতঙ্কে কমতে কমতে ৮ মার্চ এসে দাড়াঁয় ৪২৮৭ পয়েন্ট। আর ওইদিন দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে ৯ মার্চ একদিনেই ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায়। যা ১৮ মার্চ করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে ১ম রোগী মারা যাওয়ার দিন নেমে যায় ৩৬০৪ পয়েন্টে। আতঙ্কিত শেয়ারবাজারের এমন পতন ঠেকাতে ১৯ মার্চ চালু করা হয় ফ্লোর প্রাইস।  

এই ফ্লোর প্রাইস চালুর পরে লেনদেন ও সূচকে ধীরগতি আসে। এরমধ্যে গত ১৭ মে কমিশনে চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের যোগদানের মাধ্যমে পরিবর্তন আসে। এছাড়া ২০ মে কমিশনার হিসেবে ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও ড. মোঃ মিজানুর রহমান এবং ২ জুন মোঃ আব্দুল হালিম যোগদান করেন।

কমিশনের এই পরিবর্তনের পরেও করোনাভাইরাস আতঙ্কে শেয়ারবাজার ২৩ জুলাই পর্যন্ত অনেকটা একইবৃত্তে ঘুরাফেরা করে। এরপরে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ধীর গতিতে এগোয়। তবে ওইদিন মুদ্রানীতি ঘোষণার পরে ৩০ জুলাই থেকে বাজারে বড় গতি আসে। সুদ হার ও রেপো হার কমানোয় এই গতি আসে। যাতে কয়েকদিনের ব্যবধানে ২৩ জুলাইয়ের ৪০৮০ পয়েন্টের মূলসূচক ১৬ আগস্ট ৪৮৫৯ পয়েন্টে উঠে যায়। আর ২৬২ কোটি টাকার লেনদেন ১৪০০ কোটিতে উঠে আসে।

নিম্নে লেনদেন উত্থানের চিত্র তুলে ধরা হল-

মাসগড় লেনদেন (কোটি টাকা)
মে১৪৩.২৯
জুন২১৭.২৭
জুলাই২৮৫.৭৭
আগস্ট৯৭৯.৮৮

লেনদেনে উন্নতির পাশাপাশি ডিএসইর বিনিয়োগকারীরা ফিরে পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। গত মে মাসের তুলনায় ১ সেপ্টেম্বর ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের এই দাম বেড়েছে।

বাজারে এই উন্নয়নের পেছনে বর্তমান কমিশনের কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। এছাড়া আমদানি বন্ধ থাকায় মানুষের কাছে অলস অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। যা থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আসছে। এছাড়া কিছু ব্যাংকেরও তারল্য সারপ্লাস হয়ে গেছে। এখন আর কিছুদিন আগেরও তারল্যের যে চরম সংকট ছিল, তা আর নেই।

আরও পড়ুন…..
গুজবকারীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনবে বিএসইসি
আগস্টে ডিএসই থেকে রাজস্ব আদায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কমিশন একটি নতুন এবং দক্ষ নেতৃত্ব পেয়েছে। যারা বিভিন্ন কার্যকরি পদক্ষেপের মাধ্যমে দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন। যে কারনে সবাই তাদের প্রতি আশাবাদি। যাতে করে করোনাভাইরাসের আতঙ্ককে দূরে সড়িয়ে শেয়ারবাজারে গতি ফিরেছে।

প্রায় ২ মাস বন্ধ থাকার পর গত ৩১ মে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হয়। এরপর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারা ১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার জন্য গভর্ণরের সঙ্গে একটি সৌজন্য সাক্ষাত করেন। উভয়ই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে একসাথে কাজ করার বিষয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এছাড়া ভবিষ্যতে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে।

ওই সাক্ষাতের আলোকে ব্যাংকগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের ৩০ সেপ্টেম্বরের পূর্বেই নগদ লভ্যাংশ পাওয়ার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা নিয়ে ১১ মে এক নির্দেশনায় ৩০ সেপ্টেম্বরের পূর্বে ব্যাংকগুলোকে নগদ লভ্যাংশ বিতরনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।

শেয়ারবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের কারনে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে গত ২ মাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরমাধ্যমে বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি বার্তা এরইমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে অনিয়মকারীরা শাস্তি থেকে বাদ যাবে না বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। যে কারনে তাদের মধ্যে বাজারের প্রতি আস্থা বেড়েছে।

উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে জরিমানার পরিমাণ কম বলে শুরু থেকেই অভিযোগ রয়েছে। তবে শিবলী রুবাইয়াতের নতুন কমিশন সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তার কমিশন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উন্নত দেশগুলোর মতো শাস্তি দিতে না পারলেও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। যা গত ২ মাসের শাস্তির পরিমাণের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এর সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব কথার চেয়ে কাজ বেশি করছে। যার ইতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়ছে। তারা অনেকদিন ধরে আলোচনা হওয়া ‘জেড’ ক্যাটাগরি সমাধানেও এই কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই কমিশন শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি অন্যায়কারীদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনছেন। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করছে।

শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য বর্তমান কমিশন কিছু কোম্পানির আইপিও বাতিল করেছে৷ যা বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করেছে। এরমাধ্যমে ভবিষ্যতে ভালো কোম্পানি আসবে বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া আইপিও নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আপত্তি থাকলেও বর্তমান কমিশনের নিয়মিত বিডিং ও আইপিও সত্ত্বেও এখন তা দেখা যাচ্ছে না। তবে বর্তমান কমিশন শুধুমাত্র ধারনার উপর ভিত্তি করে আইপিও বাতিল করছে বলে সংশ্লিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার ও কোম্পানির সমালোচনা মধ্যে রয়েছে। তাদের দাবি, আইপিও বাতিলে আইন ব্যত্যয়ের সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ দেখাতে পারছে না কমিশন।

বর্তমান কমিশনের আইপিও বাতিল করা কোম্পানির তালিকায় বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং, বিডি পেইন্টস, বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল, আল-ফারুক ব্যাগস, বনিতো এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। তবে এরমধ্যে বিগত কমিশনের সময়েই দুটি কোম্পানির আইপিও বাতিলের বিষয় চূড়ান্ত ছিল।  

বাতিলের পাশাপাশি বর্তমান কমিশন ওয়ালটন হাইটেক পার্ক ইন্ডাস্ট্রিজ, এসোসিয়েটেড অক্সিজেন, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস, মীর আক্তার হোসেন, লুব-রেফ এর আইপিও ও বিডিং অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের রাইট অনুমোদন দিয়েছে। যার সবগুলোই বিগত কমিশনের সময় আবেদন করেছে। তবে ওই কমিশন যদি এই কোম্পানিগুলোরই আইপিও অনুমোদন দিত, তা নিয়ে একটি পক্ষ সমালোচনা করত।   

শিবলীর কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা থেকে শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দিয়েছে। গত ২ জুন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকার কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় (২৬ মার্চ-৩০ মে) সময়ে কোন কোন সিকিউরিটিজের ইস্যুয়ার, কমিশনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ডিপজিটরি, স্টক এক্সচেঞ্জ বা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য কোন ব্যক্তি কমিশনে বা স্টক এক্সচেঞ্জে বা শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের নিকট বিভিন্ন বিবরণী বা প্রতিবেদন বা রিটার্ন বা ডকুমেন্ট বা তথ্য জমাদানে, বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ব্যতীত অন্য কোন নির্দেশনা বা আদেশ পরিপালনে, বা কোন সভা নির্ধারিত সময়ে করতে ব্যর্থ হয়েছে। উক্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত সময় গণনার ক্ষেত্রে উল্লিখিত সাধারণ ছুটির সময়টি বাদ দেন৷

শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত দুর্বল মৌল ভিত্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে শিবলীর নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারই অংশ হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করতে বর্তমান কমিশন নতুন করে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে৷ যা কোম্পানিগুলোকে ব্যবসায় উন্নতি করতে সহযোগিতা করবে। এরমধ্যে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ধারনকৃত শেয়ারে বিক্রি, হস্তান্তর ও বন্ধকী দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া পর্ষদ পূণর্গঠন, বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ, পর্যবেক্ষক বসানো ও পয়তাল্লিশ কর্মদিবসের মধ্যে বিদ্যমান বোর্ড পূনর্গঠন করতে ব্যর্থ হলে বর্তমান পরিচালক ও উদ্যোক্তাদেরকে শেয়ারবাজারে কোন তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে থাকার সুযোগ বন্ধ করেছে। কমিশনের এসব সিদ্ধান্ত ‘জেড’ ক্যাটাগরির সংস্কারে কার্যকরি পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা

অন্যদিকে কমিশনের কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে ‘জেড’ ক্যাটাগরি কোম্পানির সংখ্যা বাড়বে। তবে সেটেলমেন্ট সম্পন্ন করার সময় কমিয়ে টি+৩-তে আনার কারনে তার সুফল পাওয়া যাবে না। কমিশন পরপর দুইবছর নগদ লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া পরপর ২ বছর এজিএম করতে ব্যর্থ হলে, পরপর ২ বছর পরিচালন লোকসান ও ঋণাত্মক পরিচালন নগদ প্রবাহ এবং পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে সংরক্ষিত আয় বেশি ঋণাত্মক হওয়া কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানো হবে।

বিজনেস আওয়ার/০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

এগিয়ে যাচ্ছে শেয়ারবাজার

পোস্ট হয়েছে : ১০:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

রেজোয়ান আহমেদ : করোনাভাইরাস মহামারিকে দূরে সড়িয়ে শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন। যা সহজ হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের আতঙ্ক দূর হওয়ায়। এছাড়া নতুন কমিশনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বড় আর্থিক জরিমানা ও কিছু কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাতিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়িয়েছে। আর ব্যাংকের সুদের হার তলানিতে নেমে আসায় শেয়ারবাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। যাতে করে শেয়ারবাজারে মূল্যসূচক, বাজার মূলধন ও আর্থিক লেনদেনে বড় উন্নতি হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে সেটা ভয়াবহ রূপ ধারন করে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে। এরপরই বিনিয়োগকারীরা যার যার অবস্থান থেকে শুধু বিক্রি করার চেষ্টাই করে গেছেন। বাজারে দেখা দেয় ক্রেতার ভয়াবহ সংকট। তবে এখন করোনাভাইরাস নিয়ে সেই আতঙ্ক নেই। এছাড়া নতুন কমিশনের কিছু পদক্ষেপ বাড়তি আস্থা যুগিয়েছে। যাতে করে শেয়ারবাজার এগিয়ে যাচ্ছে।

দেখা গেছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি ৪৭৬৮ পয়েন্টে ছিল। যেটা করোনা আতঙ্কে কমতে কমতে ৮ মার্চ এসে দাড়াঁয় ৪২৮৭ পয়েন্ট। আর ওইদিন দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে ৯ মার্চ একদিনেই ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায়। যা ১৮ মার্চ করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে ১ম রোগী মারা যাওয়ার দিন নেমে যায় ৩৬০৪ পয়েন্টে। আতঙ্কিত শেয়ারবাজারের এমন পতন ঠেকাতে ১৯ মার্চ চালু করা হয় ফ্লোর প্রাইস।  

এই ফ্লোর প্রাইস চালুর পরে লেনদেন ও সূচকে ধীরগতি আসে। এরমধ্যে গত ১৭ মে কমিশনে চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের যোগদানের মাধ্যমে পরিবর্তন আসে। এছাড়া ২০ মে কমিশনার হিসেবে ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও ড. মোঃ মিজানুর রহমান এবং ২ জুন মোঃ আব্দুল হালিম যোগদান করেন।

কমিশনের এই পরিবর্তনের পরেও করোনাভাইরাস আতঙ্কে শেয়ারবাজার ২৩ জুলাই পর্যন্ত অনেকটা একইবৃত্তে ঘুরাফেরা করে। এরপরে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ধীর গতিতে এগোয়। তবে ওইদিন মুদ্রানীতি ঘোষণার পরে ৩০ জুলাই থেকে বাজারে বড় গতি আসে। সুদ হার ও রেপো হার কমানোয় এই গতি আসে। যাতে কয়েকদিনের ব্যবধানে ২৩ জুলাইয়ের ৪০৮০ পয়েন্টের মূলসূচক ১৬ আগস্ট ৪৮৫৯ পয়েন্টে উঠে যায়। আর ২৬২ কোটি টাকার লেনদেন ১৪০০ কোটিতে উঠে আসে।

নিম্নে লেনদেন উত্থানের চিত্র তুলে ধরা হল-

মাসগড় লেনদেন (কোটি টাকা)
মে১৪৩.২৯
জুন২১৭.২৭
জুলাই২৮৫.৭৭
আগস্ট৯৭৯.৮৮

লেনদেনে উন্নতির পাশাপাশি ডিএসইর বিনিয়োগকারীরা ফিরে পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। গত মে মাসের তুলনায় ১ সেপ্টেম্বর ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের এই দাম বেড়েছে।

বাজারে এই উন্নয়নের পেছনে বর্তমান কমিশনের কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। এছাড়া আমদানি বন্ধ থাকায় মানুষের কাছে অলস অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। যা থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আসছে। এছাড়া কিছু ব্যাংকেরও তারল্য সারপ্লাস হয়ে গেছে। এখন আর কিছুদিন আগেরও তারল্যের যে চরম সংকট ছিল, তা আর নেই।

আরও পড়ুন…..
গুজবকারীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনবে বিএসইসি
আগস্টে ডিএসই থেকে রাজস্ব আদায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কমিশন একটি নতুন এবং দক্ষ নেতৃত্ব পেয়েছে। যারা বিভিন্ন কার্যকরি পদক্ষেপের মাধ্যমে দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন। যে কারনে সবাই তাদের প্রতি আশাবাদি। যাতে করে করোনাভাইরাসের আতঙ্ককে দূরে সড়িয়ে শেয়ারবাজারে গতি ফিরেছে।

প্রায় ২ মাস বন্ধ থাকার পর গত ৩১ মে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হয়। এরপর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারা ১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার জন্য গভর্ণরের সঙ্গে একটি সৌজন্য সাক্ষাত করেন। উভয়ই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে একসাথে কাজ করার বিষয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এছাড়া ভবিষ্যতে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে।

ওই সাক্ষাতের আলোকে ব্যাংকগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের ৩০ সেপ্টেম্বরের পূর্বেই নগদ লভ্যাংশ পাওয়ার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা নিয়ে ১১ মে এক নির্দেশনায় ৩০ সেপ্টেম্বরের পূর্বে ব্যাংকগুলোকে নগদ লভ্যাংশ বিতরনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।

শেয়ারবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের কারনে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে গত ২ মাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরমাধ্যমে বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি বার্তা এরইমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে অনিয়মকারীরা শাস্তি থেকে বাদ যাবে না বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। যে কারনে তাদের মধ্যে বাজারের প্রতি আস্থা বেড়েছে।

উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে জরিমানার পরিমাণ কম বলে শুরু থেকেই অভিযোগ রয়েছে। তবে শিবলী রুবাইয়াতের নতুন কমিশন সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তার কমিশন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উন্নত দেশগুলোর মতো শাস্তি দিতে না পারলেও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। যা গত ২ মাসের শাস্তির পরিমাণের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এর সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব কথার চেয়ে কাজ বেশি করছে। যার ইতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়ছে। তারা অনেকদিন ধরে আলোচনা হওয়া ‘জেড’ ক্যাটাগরি সমাধানেও এই কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই কমিশন শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি অন্যায়কারীদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনছেন। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করছে।

শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য বর্তমান কমিশন কিছু কোম্পানির আইপিও বাতিল করেছে৷ যা বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করেছে। এরমাধ্যমে ভবিষ্যতে ভালো কোম্পানি আসবে বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া আইপিও নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আপত্তি থাকলেও বর্তমান কমিশনের নিয়মিত বিডিং ও আইপিও সত্ত্বেও এখন তা দেখা যাচ্ছে না। তবে বর্তমান কমিশন শুধুমাত্র ধারনার উপর ভিত্তি করে আইপিও বাতিল করছে বলে সংশ্লিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার ও কোম্পানির সমালোচনা মধ্যে রয়েছে। তাদের দাবি, আইপিও বাতিলে আইন ব্যত্যয়ের সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ দেখাতে পারছে না কমিশন।

বর্তমান কমিশনের আইপিও বাতিল করা কোম্পানির তালিকায় বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং, বিডি পেইন্টস, বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল, আল-ফারুক ব্যাগস, বনিতো এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। তবে এরমধ্যে বিগত কমিশনের সময়েই দুটি কোম্পানির আইপিও বাতিলের বিষয় চূড়ান্ত ছিল।  

বাতিলের পাশাপাশি বর্তমান কমিশন ওয়ালটন হাইটেক পার্ক ইন্ডাস্ট্রিজ, এসোসিয়েটেড অক্সিজেন, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস, মীর আক্তার হোসেন, লুব-রেফ এর আইপিও ও বিডিং অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের রাইট অনুমোদন দিয়েছে। যার সবগুলোই বিগত কমিশনের সময় আবেদন করেছে। তবে ওই কমিশন যদি এই কোম্পানিগুলোরই আইপিও অনুমোদন দিত, তা নিয়ে একটি পক্ষ সমালোচনা করত।   

শিবলীর কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা থেকে শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দিয়েছে। গত ২ জুন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সরকার কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় (২৬ মার্চ-৩০ মে) সময়ে কোন কোন সিকিউরিটিজের ইস্যুয়ার, কমিশনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ডিপজিটরি, স্টক এক্সচেঞ্জ বা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য কোন ব্যক্তি কমিশনে বা স্টক এক্সচেঞ্জে বা শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের নিকট বিভিন্ন বিবরণী বা প্রতিবেদন বা রিটার্ন বা ডকুমেন্ট বা তথ্য জমাদানে, বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ব্যতীত অন্য কোন নির্দেশনা বা আদেশ পরিপালনে, বা কোন সভা নির্ধারিত সময়ে করতে ব্যর্থ হয়েছে। উক্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত সময় গণনার ক্ষেত্রে উল্লিখিত সাধারণ ছুটির সময়টি বাদ দেন৷

শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত দুর্বল মৌল ভিত্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে শিবলীর নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারই অংশ হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করতে বর্তমান কমিশন নতুন করে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে৷ যা কোম্পানিগুলোকে ব্যবসায় উন্নতি করতে সহযোগিতা করবে। এরমধ্যে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ধারনকৃত শেয়ারে বিক্রি, হস্তান্তর ও বন্ধকী দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া পর্ষদ পূণর্গঠন, বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ, পর্যবেক্ষক বসানো ও পয়তাল্লিশ কর্মদিবসের মধ্যে বিদ্যমান বোর্ড পূনর্গঠন করতে ব্যর্থ হলে বর্তমান পরিচালক ও উদ্যোক্তাদেরকে শেয়ারবাজারে কোন তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে থাকার সুযোগ বন্ধ করেছে। কমিশনের এসব সিদ্ধান্ত ‘জেড’ ক্যাটাগরির সংস্কারে কার্যকরি পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা

অন্যদিকে কমিশনের কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে ‘জেড’ ক্যাটাগরি কোম্পানির সংখ্যা বাড়বে। তবে সেটেলমেন্ট সম্পন্ন করার সময় কমিয়ে টি+৩-তে আনার কারনে তার সুফল পাওয়া যাবে না। কমিশন পরপর দুইবছর নগদ লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া পরপর ২ বছর এজিএম করতে ব্যর্থ হলে, পরপর ২ বছর পরিচালন লোকসান ও ঋণাত্মক পরিচালন নগদ প্রবাহ এবং পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে সংরক্ষিত আয় বেশি ঋণাত্মক হওয়া কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানো হবে।

বিজনেস আওয়ার/০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: