ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এবারের বাজেটে পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ

  • পোস্ট হয়েছে : ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩
  • 44

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হবে বৃহস্পতিবার (১ জুন)। আগামী ২৬ জুন বাজেট পাসের পর অধিবেশন মুলতবি করা হবে।

এমন এক সময়ে বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে, যখন দেশে চরম মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ-ডলার সংকট, রাজস্ব আদায় কম, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত এবং বছর শেষে জাতীয় নির্বাচন ইত্যাদি কারণে এ বছর বাজেট হবে বড় চ্যালেঞ্জিং।

বিকেল ৩টায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট পেশ করবেন। আগামী বোরবার থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হবে। সোমবার সম্পূরক বাজেট পাস হবে।

অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, অন্যসব বছরের তুলনায় এ বছরের বাজেট কিছুটা চ্যালেঞ্জের হবে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে সব সরকারই জনতুষ্টিমূলক বাজেট দিতে চায়। কারণ অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে যেসব বাজেট দেয়া হয়, সেখানে অর্থনীতির উন্নতির তুলনায় জনতুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

তবে এবার আর্থিক অবস্থা ও রাজস্ব ঘাটতির কারণে সে সুযোগ খুব সীমিত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তগুলো বাস্তবায়নেরও চাপ থাকবে। এ বছরের বাজেটে আইএমএফ’র শর্তগুলো অনেকটা ‘ছায়া’ আকারে থাকবে।

আইএমএফ’র ঋণ অব্যাহত রাখতে যতটা সম্ভব তাদের শর্তগুলোও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা থাকবে। এজন্য ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় ও অন্যসব বিবেচনায় নিয়ে বাজেট পেশ করতে হবে।

সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এবারই সামষ্টিক অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আইএমএফ’র শর্ত এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সার্বিকভাবে সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার যেন সুচিন্তিত এবং স্বচ্ছ হয়। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আইনের প্রয়োগ করতে হবে।

এ ছাড়া পাচার করা টাকা দেশে আনার সুযোগ বাতিল করতে হবে। আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী কর ছাড় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের এনবিআর’র শুল্ক-কর আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সার্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। তাই আগামী বাজেট চ্যালেঞ্জের হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই আগামী বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা:
দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এ বছরের বাজেটে কী ধরনের প্রস্তাবনা করা হয়, সেটির দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। সেটা রক্ষা করাই এই বাজেটের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করা হচ্ছে, বাজেটে সেটার পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে হবে। বিশ্বের বাজারে অনেক কিছুর দাম কমে আসলেও তার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। এসব সংকট কীভাবে সামলানো হবে, তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে থাকা দরকার। না হলে বড় সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যাবে।

২. আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ:
এদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দেয়ার চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পক্ষ থেকে। কিন্তু ভর্তুকি কমানো হলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আইএমএফ’র শর্ত বিবেচনায় নেয়া স্বত্ত্বেও এ বছরেও সার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বাজেটে প্রথমে ভর্তুকি ৮৫ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হলেও পরবর্তীতে বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি করা হয়েছিল।

আইএমএফ সাড়ে ৩ বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফ’র চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।

৩. রাজস্ব আদায়:
দেশে বরাবরই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, কখনোই সেটা পুরোপুরি সফল করা যায় না। এ জন্য দেশের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনাকে যেমন দায়ী করা হচ্ছে, তেমনি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নানারকম ছাড় দেয়াকেও দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এ বছর আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আইএমএফ’র শর্তে জিডিপির অতিরিক্ত ০.৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

অধ্যাপক রায়হান বলেন, রাজস্ব আদায়ের জায়গায় আমাদের সাফল্য খুবই কম। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হলেও সেখানে এখনো ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে।

৪. বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ:
ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি কমিয়ে আনা আর রিজার্ভ কমে যাওয়া, এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বাজেটে। বৈদেশিক লেনদেনের ওপর ঘাটতি বড় আকারে বেড়েছে। এজন্য টাকার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। টাকার আরও পতন হলে আমদানি করা পণ্যের দাম আরও বাড়বে। গত বছরের এই সময়ে দেশে রিজার্ভ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি, এই বছরে সেটি ৩ হাজার কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ এই মুহূর্তে দেখা না গেলেও আগামী বাজেটে এ বিষয়ে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইমএফ’র শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং আর্থিক খাতের সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতির চেহারা পালটে দিয়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত। উচ্চাভিলাষী বাজেট না হওয়াই ভালো। দাম স্বাভাবিক রাখতে নিত্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের ওপর কর প্রত্যাহার এবং কৃষি খাতে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।

পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ’র দেয়া রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও রিজার্ভ সংরক্ষণের দুই শর্ত পূরণে সরকার ব্যর্থ হতে পারে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিষয়টি যদিও অর্থবছর শেষ না হলে মূল্যায়ন হবে না। তবে যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব হবে। তিনি বলেন, পুরোনো দায়ের কারণে ভর্তুকি এবার বাড়বে এবং বাজেটে বরাদ্দও বাড়বে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যে হারে কমেছে, পরেরবার আর ভর্তুকি বাড়বে না।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থির রাখার চেষ্টা আরও বেশি জরুরি। যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। এজন্য রিজার্ভ বাড়ানোর ওপরই বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। একইসঙ্গে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও দূর করতে হবে।

৫. আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা
অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, বর্তমান আর্থিক সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও, আসলে আমাদের দেশেই দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক যেসব নীতি ও কৌশল নেয়া হচ্ছিল, সেগুলোর অনেক প্রভাব রয়েছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এখনো চ্যালেঞ্জ হিসাবে থেকে যাচ্ছে এ বছরের বাজেটেও

আর্থিক খাতে ঋণ খেলাপি, সুশাসনের অভাব, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়েছে। বিভিন্ন সময় সংস্কারের যেসব তাগিদ দেয়া হয়েছে, অনেক দিন ধরেই সেসব অবহেলিত রয়েছে। আইএমএফ কিছু সংস্কারের কথা বললেও তার কিছু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিছু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশেষ করে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাত খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইমএফের শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং আর্থিক খাতের সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একটা পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা, আর্থিক খাতের ঋণ খেলাপিসহ অব্যবস্থাপনা দূর করতে কী করা হবে, তার পরিষ্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিজনেস আওয়ার/১ জুন, ২০২৩/এএইচএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

এবারের বাজেটে পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ

পোস্ট হয়েছে : ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হবে বৃহস্পতিবার (১ জুন)। আগামী ২৬ জুন বাজেট পাসের পর অধিবেশন মুলতবি করা হবে।

এমন এক সময়ে বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে, যখন দেশে চরম মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ-ডলার সংকট, রাজস্ব আদায় কম, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত এবং বছর শেষে জাতীয় নির্বাচন ইত্যাদি কারণে এ বছর বাজেট হবে বড় চ্যালেঞ্জিং।

বিকেল ৩টায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট পেশ করবেন। আগামী বোরবার থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হবে। সোমবার সম্পূরক বাজেট পাস হবে।

অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, অন্যসব বছরের তুলনায় এ বছরের বাজেট কিছুটা চ্যালেঞ্জের হবে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে সব সরকারই জনতুষ্টিমূলক বাজেট দিতে চায়। কারণ অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে যেসব বাজেট দেয়া হয়, সেখানে অর্থনীতির উন্নতির তুলনায় জনতুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

তবে এবার আর্থিক অবস্থা ও রাজস্ব ঘাটতির কারণে সে সুযোগ খুব সীমিত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তগুলো বাস্তবায়নেরও চাপ থাকবে। এ বছরের বাজেটে আইএমএফ’র শর্তগুলো অনেকটা ‘ছায়া’ আকারে থাকবে।

আইএমএফ’র ঋণ অব্যাহত রাখতে যতটা সম্ভব তাদের শর্তগুলোও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা থাকবে। এজন্য ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় ও অন্যসব বিবেচনায় নিয়ে বাজেট পেশ করতে হবে।

সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এবারই সামষ্টিক অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আইএমএফ’র শর্ত এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সার্বিকভাবে সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার যেন সুচিন্তিত এবং স্বচ্ছ হয়। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আইনের প্রয়োগ করতে হবে।

এ ছাড়া পাচার করা টাকা দেশে আনার সুযোগ বাতিল করতে হবে। আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী কর ছাড় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের এনবিআর’র শুল্ক-কর আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সার্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। তাই আগামী বাজেট চ্যালেঞ্জের হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই আগামী বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা:
দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এ বছরের বাজেটে কী ধরনের প্রস্তাবনা করা হয়, সেটির দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। সেটা রক্ষা করাই এই বাজেটের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করা হচ্ছে, বাজেটে সেটার পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে হবে। বিশ্বের বাজারে অনেক কিছুর দাম কমে আসলেও তার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। এসব সংকট কীভাবে সামলানো হবে, তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে থাকা দরকার। না হলে বড় সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যাবে।

২. আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ:
এদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দেয়ার চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পক্ষ থেকে। কিন্তু ভর্তুকি কমানো হলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আইএমএফ’র শর্ত বিবেচনায় নেয়া স্বত্ত্বেও এ বছরেও সার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বাজেটে প্রথমে ভর্তুকি ৮৫ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হলেও পরবর্তীতে বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি করা হয়েছিল।

আইএমএফ সাড়ে ৩ বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফ’র চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।

৩. রাজস্ব আদায়:
দেশে বরাবরই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, কখনোই সেটা পুরোপুরি সফল করা যায় না। এ জন্য দেশের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনাকে যেমন দায়ী করা হচ্ছে, তেমনি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নানারকম ছাড় দেয়াকেও দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এ বছর আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আইএমএফ’র শর্তে জিডিপির অতিরিক্ত ০.৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

অধ্যাপক রায়হান বলেন, রাজস্ব আদায়ের জায়গায় আমাদের সাফল্য খুবই কম। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হলেও সেখানে এখনো ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে।

৪. বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ:
ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি কমিয়ে আনা আর রিজার্ভ কমে যাওয়া, এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বাজেটে। বৈদেশিক লেনদেনের ওপর ঘাটতি বড় আকারে বেড়েছে। এজন্য টাকার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। টাকার আরও পতন হলে আমদানি করা পণ্যের দাম আরও বাড়বে। গত বছরের এই সময়ে দেশে রিজার্ভ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি, এই বছরে সেটি ৩ হাজার কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ এই মুহূর্তে দেখা না গেলেও আগামী বাজেটে এ বিষয়ে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইমএফ’র শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং আর্থিক খাতের সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতির চেহারা পালটে দিয়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত। উচ্চাভিলাষী বাজেট না হওয়াই ভালো। দাম স্বাভাবিক রাখতে নিত্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের ওপর কর প্রত্যাহার এবং কৃষি খাতে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।

পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ’র দেয়া রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও রিজার্ভ সংরক্ষণের দুই শর্ত পূরণে সরকার ব্যর্থ হতে পারে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিষয়টি যদিও অর্থবছর শেষ না হলে মূল্যায়ন হবে না। তবে যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব হবে। তিনি বলেন, পুরোনো দায়ের কারণে ভর্তুকি এবার বাড়বে এবং বাজেটে বরাদ্দও বাড়বে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যে হারে কমেছে, পরেরবার আর ভর্তুকি বাড়বে না।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থির রাখার চেষ্টা আরও বেশি জরুরি। যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। এজন্য রিজার্ভ বাড়ানোর ওপরই বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। একইসঙ্গে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও দূর করতে হবে।

৫. আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা
অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, বর্তমান আর্থিক সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও, আসলে আমাদের দেশেই দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক যেসব নীতি ও কৌশল নেয়া হচ্ছিল, সেগুলোর অনেক প্রভাব রয়েছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এখনো চ্যালেঞ্জ হিসাবে থেকে যাচ্ছে এ বছরের বাজেটেও

আর্থিক খাতে ঋণ খেলাপি, সুশাসনের অভাব, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়েছে। বিভিন্ন সময় সংস্কারের যেসব তাগিদ দেয়া হয়েছে, অনেক দিন ধরেই সেসব অবহেলিত রয়েছে। আইএমএফ কিছু সংস্কারের কথা বললেও তার কিছু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিছু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশেষ করে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাত খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইমএফের শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং আর্থিক খাতের সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একটা পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা, আর্থিক খাতের ঋণ খেলাপিসহ অব্যবস্থাপনা দূর করতে কী করা হবে, তার পরিষ্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিজনেস আওয়ার/১ জুন, ২০২৩/এএইচএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: