ঢাকা , রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হোয়াটসঅ্যাপে হত্যার রহস্য উদঘাটন, ব্রুনাই ফেরত যাত্রী আটক

  • পোস্ট হয়েছে : ০৪:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩
  • 6

বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: পরকীয়া প্রেমিকাকে ঢাকায় এনে বিয়ের আশ্বাসে ২০১৯ সালের ১৬ জুন চাঁদপুর থেকে লঞ্চে রওনা দেন দেলোয়ার মিজি (৪৪)। লঞ্চের কেবিনেই ওই নারীকে খুন করে সকালে ঢাকায় নেমে যান তিনি।

১৭ জুন সকালে মিতালি-৭ লঞ্চের কেবিন থেকে নিলুফা বেগম (৫৭) নামে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে লঞ্চের কেবিন বুকিংয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিলুফারের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নাম। আর যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে সেটি বন্ধ।

এদিকে, পুলিশ হাজিগঞ্জে ভিকটিম নিলুফার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এলাকার মুদি দোকানির নাম জাহাঙ্গীর। তবে ঘটনার দিন জাহাঙ্গীরের অন্য কোথাও যাওয়ার প্রমাণ নেই।

ক্লুলেস এই মামলার তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যরা সন্দেহ করেন নিলুফার আরেক প্রতিবেশী দেলোয়ারকে। কিন্তু ততদিন দেলোয়ার ব্রুনাই পাড়ি দিয়েছেন। রহস্যের কোনো কুলকিনারা করতে না পেরে অপেক্ষা করতে থাকেন তদন্ত কর্মকর্তারা, যাতে অপরাধী বুঝতে পারেন এ ঘটনায় পুলিশের আর কোনো আগ্রহ নেই।

প্রায় সাড়ে চার বছর পর অপেক্ষার অবসান ঘটে দেলোয়ার মিজির দেশে ফেরত আসার মাধ্যমে। গত ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার পর ঢাকার বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। কোন ক্লু না থাকা এবং দেলোয়ার স্বীকার না করায় অপেক্ষা আরও বাড়তে থাকে।

একপর্যায়ে দেলোয়ারের মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েজ মেসেজের সূত্র ধরে উদঘাটন হয় রহস্যের। একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন দেলোয়ার।

৪ বছর আগে যা ঘটেছিল
ভিকটিম নিলুফা বেগম (৫৭) ২০১৯ সালের ১৬ জুন রাত ১০টার দিকে ঢাকায় আসার জন্য চাঁদপুর থেকে মিতালি-৭ লঞ্চের এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। পরদিন সকাল ৯টার দিকে লঞ্চের কেবিন বয় ভিকটিমের লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দেয়।

পিবিআইয়ের ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিমের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করে। থানা পুলিশ পরিবারকে বিষয়টি জানালে ভিকটিমের ভাই মনির হোসেন এসে লাশ শনাক্ত করেন।

লঞ্চের বুকিং রেজিস্টারে ছিল নিলুফার প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নাম এবং মোবাইল নম্বরটি ছিল ভিকটিমের। নিহত নিলুফা বেগমের সঙ্গে প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের সখ্য থাকায় তাকে সন্দেহ করে মামলার আসামি করা হয়।

থানা পুলিশের প্রায় ১ মাসের তদন্তের পর মামলাটি পিবিআই’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর অপেক্ষার পর মামলাটির রহস্য উদঘাটনসহ আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পিবিআই।

যেভাবে চলে তদন্ত
তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান আসামি ভিকটিমের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। কিন্তু ঘটনার আগে-পরে জাহাঙ্গীরের কোনো মুভমেন্ট না পাওয়ায় অন্যপথে হাঁটতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তদন্তে ভিকটিমের সঙ্গে একই গ্রামের একটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ দেখে সেখানে খোঁজ নেওয়া হয়। দেখা যায়, নম্বরটি প্রতিবেশী এক নারীর। ওই নারীর সঙ্গে ভিকটিমের মাঝে মাঝে কথা হতো বলে জানা যায়। তবে ওই নারী পুলিশকে জানান, তার ব্রুনাই প্রবাসী স্বামী দেশে ফিরলে মাঝেমধ্যে তার মোবাইলটিই ব্যবহার করেন। তিনি ২৬ জুন ব্রুনাই চলে গেছেন।

একপর্যায়ে ব্রুনাই প্রবাসী দেলোয়ার মিজির সঙ্গে ভিকটিম নিলুফার পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি সন্দেহ হয়। পিবিআই দেলোয়ার মিজির পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন পুলিশকে অবহিত করে।

পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এরমধ্যে আমরা ওই এলাকায় কোনো তৎপরতা দেখাইনি। যাতে সবাই বুঝতে পারে পুলিশের এ নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা দেলোয়ারের দেশে ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি।

প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে অপেক্ষার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার পর ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় ঢাকার বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসে রহস্য।

যেভাবে রহস্য উদঘাটন
পিবিআই জানায়, প্রাথমিকভাবে দেলোয়ার কোনভাবেই ভিকটিম নিলুফার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক বা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করছিলেন না। তার সাথে থাকা মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন জানান, তাই সেটিও খোলা যাচ্ছিল না।

একপর্যায়ে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা র‍্যানডম পসওয়ার্ড বসিয়ে ফোনটি আনলক করতে সক্ষম হন। খুঁজতে খুঁজতে তার হোয়াটসঅ্যাপে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েজ মেসেজেই বেরিয়ে আসে ক্লু।

দেশে আসার কিছু দিন আগে পাঠানো ওই ভয়েস মেসেজে ভিকটিম নিলুফা হত্যা মামলার খোঁজ খবর নিতে বলেন এবং মামলা শেষ করতে যদি টাকা পয়সাও লাগে সেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলেন। দেশে এলে সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসেই তিনি ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশে আসেন।

এরপর এ বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দেলোয়ার মিজি নিলুফা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।

যে কারণে হত্যা
জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার মিজি জানান, ভিকটিম নিলুফা বেগমের স্বামী ২০১৫ সালে মারা যান। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। ২০১২ সালের দিকে ভিকটিমের বাড়িতে কাঠমিস্ত্রীর কাজের সুবাদে তার সঙ্গে ভিকটিমের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালে তিনি ব্রুনাই চলে গেলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে।

দেলোয়ার মিজি ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। দেশে আসার পর তিনি ভিকটিম নিলুফার সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করেন। এরপর নিলুফা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তিনি নিলুফাকে বিয়ে করবেন বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকলে নিলুফা তার বাড়িতে গিয়ে উঠবে বলে হুমকি দিতে থাকেন। দেলোয়ার মিজির বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হলে ভিকটিম নিলুফা সেখানে গিয়ে সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন।

দেলোয়ার মিজি তাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেন এবং বিদেশ যাওয়ার আগেই তাকে বিয়ে করে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। নিলুফা ১৩ বছরের বড় হওয়ায় দেলোয়ার মিজি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। মানসম্মানের কথা চিন্তা করে নিলুফাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১৬ জুন দেলোয়ার নিলুফাকে বিয়ের কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য লঞ্চে রওনা দেন। ভিকটিমের প্রতিবেশী মুদির দোকানদার জাহাঙ্গীরের নাম এবং ভিকটিমের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে লঞ্চের কেবিন বুকিং করেন।

নিলুফাকে হত্যা করে দায় জাহাঙ্গীরের ওপর সুকৌশলে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি জাহাঙ্গীরের নাম ব্যবহার করেন। কারণ তিনি জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ভিকটিমের সখ্য থাকার বিষয়টি জানতেন। পুলিশের সন্দেহ এড়ানোর জন্য দেলোয়ার তার নিজের মোবাইলটিও বাড়িতে রেখে আসেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী দেলোয়ার এবং নিলুফা ১৬ জুন রাতে চাঁদপুর থেকে মিতালি-৭ লঞ্চের তৃতীয় তলার এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। লঞ্চ ছাড়ার পর রাত ১২টার দিকে তিনি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিলুফাকে ধর্ষণ করেন। রাত দেড়টার দিকে বিয়ের কথা নিয়ে নিলুফার সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তিনি নিলুফার গলা চেপে ধরেন। পরে তার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ভিকটিমের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ভিকটিমের মোবাইলে থাকায় দেলোয়ার ভিকটিমের দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে বিদেশ চলে যান। দেশে ফেরার সময় সেগুলো সঙ্গে আনেননি দেলোয়ার। যেহেতু সেই মোবাইলগুলো উদ্ধার করা যায়নি, সেই আলামতও উদ্ধার করা যায়নি। দেলোয়ার মিজিকে আদালতে সোপর্দ করা হলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বিজনেস আওয়ার/১২ অক্টোবর, ২০২৩/এএইচএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

হোয়াটসঅ্যাপে হত্যার রহস্য উদঘাটন, ব্রুনাই ফেরত যাত্রী আটক

পোস্ট হয়েছে : ০৪:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৩

বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: পরকীয়া প্রেমিকাকে ঢাকায় এনে বিয়ের আশ্বাসে ২০১৯ সালের ১৬ জুন চাঁদপুর থেকে লঞ্চে রওনা দেন দেলোয়ার মিজি (৪৪)। লঞ্চের কেবিনেই ওই নারীকে খুন করে সকালে ঢাকায় নেমে যান তিনি।

১৭ জুন সকালে মিতালি-৭ লঞ্চের কেবিন থেকে নিলুফা বেগম (৫৭) নামে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে লঞ্চের কেবিন বুকিংয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিলুফারের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নাম। আর যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে সেটি বন্ধ।

এদিকে, পুলিশ হাজিগঞ্জে ভিকটিম নিলুফার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এলাকার মুদি দোকানির নাম জাহাঙ্গীর। তবে ঘটনার দিন জাহাঙ্গীরের অন্য কোথাও যাওয়ার প্রমাণ নেই।

ক্লুলেস এই মামলার তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যরা সন্দেহ করেন নিলুফার আরেক প্রতিবেশী দেলোয়ারকে। কিন্তু ততদিন দেলোয়ার ব্রুনাই পাড়ি দিয়েছেন। রহস্যের কোনো কুলকিনারা করতে না পেরে অপেক্ষা করতে থাকেন তদন্ত কর্মকর্তারা, যাতে অপরাধী বুঝতে পারেন এ ঘটনায় পুলিশের আর কোনো আগ্রহ নেই।

প্রায় সাড়ে চার বছর পর অপেক্ষার অবসান ঘটে দেলোয়ার মিজির দেশে ফেরত আসার মাধ্যমে। গত ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার পর ঢাকার বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। কোন ক্লু না থাকা এবং দেলোয়ার স্বীকার না করায় অপেক্ষা আরও বাড়তে থাকে।

একপর্যায়ে দেলোয়ারের মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েজ মেসেজের সূত্র ধরে উদঘাটন হয় রহস্যের। একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন দেলোয়ার।

৪ বছর আগে যা ঘটেছিল
ভিকটিম নিলুফা বেগম (৫৭) ২০১৯ সালের ১৬ জুন রাত ১০টার দিকে ঢাকায় আসার জন্য চাঁদপুর থেকে মিতালি-৭ লঞ্চের এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। পরদিন সকাল ৯টার দিকে লঞ্চের কেবিন বয় ভিকটিমের লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দেয়।

পিবিআইয়ের ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিমের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করে। থানা পুলিশ পরিবারকে বিষয়টি জানালে ভিকটিমের ভাই মনির হোসেন এসে লাশ শনাক্ত করেন।

লঞ্চের বুকিং রেজিস্টারে ছিল নিলুফার প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের নাম এবং মোবাইল নম্বরটি ছিল ভিকটিমের। নিহত নিলুফা বেগমের সঙ্গে প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের সখ্য থাকায় তাকে সন্দেহ করে মামলার আসামি করা হয়।

থানা পুলিশের প্রায় ১ মাসের তদন্তের পর মামলাটি পিবিআই’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর অপেক্ষার পর মামলাটির রহস্য উদঘাটনসহ আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পিবিআই।

যেভাবে চলে তদন্ত
তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান আসামি ভিকটিমের প্রতিবেশী জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। কিন্তু ঘটনার আগে-পরে জাহাঙ্গীরের কোনো মুভমেন্ট না পাওয়ায় অন্যপথে হাঁটতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তদন্তে ভিকটিমের সঙ্গে একই গ্রামের একটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ দেখে সেখানে খোঁজ নেওয়া হয়। দেখা যায়, নম্বরটি প্রতিবেশী এক নারীর। ওই নারীর সঙ্গে ভিকটিমের মাঝে মাঝে কথা হতো বলে জানা যায়। তবে ওই নারী পুলিশকে জানান, তার ব্রুনাই প্রবাসী স্বামী দেশে ফিরলে মাঝেমধ্যে তার মোবাইলটিই ব্যবহার করেন। তিনি ২৬ জুন ব্রুনাই চলে গেছেন।

একপর্যায়ে ব্রুনাই প্রবাসী দেলোয়ার মিজির সঙ্গে ভিকটিম নিলুফার পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি সন্দেহ হয়। পিবিআই দেলোয়ার মিজির পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন পুলিশকে অবহিত করে।

পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এরমধ্যে আমরা ওই এলাকায় কোনো তৎপরতা দেখাইনি। যাতে সবাই বুঝতে পারে পুলিশের এ নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা দেলোয়ারের দেশে ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি।

প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে অপেক্ষার পর গত ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরার পর ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় ঢাকার বিমানবন্দর থেকে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে আসে রহস্য।

যেভাবে রহস্য উদঘাটন
পিবিআই জানায়, প্রাথমিকভাবে দেলোয়ার কোনভাবেই ভিকটিম নিলুফার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক বা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করছিলেন না। তার সাথে থাকা মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন জানান, তাই সেটিও খোলা যাচ্ছিল না।

একপর্যায়ে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা র‍্যানডম পসওয়ার্ড বসিয়ে ফোনটি আনলক করতে সক্ষম হন। খুঁজতে খুঁজতে তার হোয়াটসঅ্যাপে এক প্রতিবেশীকে পাঠানো একটি ভয়েজ মেসেজেই বেরিয়ে আসে ক্লু।

দেশে আসার কিছু দিন আগে পাঠানো ওই ভয়েস মেসেজে ভিকটিম নিলুফা হত্যা মামলার খোঁজ খবর নিতে বলেন এবং মামলা শেষ করতে যদি টাকা পয়সাও লাগে সেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলেন। দেশে এলে সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসেই তিনি ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশে আসেন।

এরপর এ বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে দেলোয়ার মিজি নিলুফা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।

যে কারণে হত্যা
জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার মিজি জানান, ভিকটিম নিলুফা বেগমের স্বামী ২০১৫ সালে মারা যান। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। ২০১২ সালের দিকে ভিকটিমের বাড়িতে কাঠমিস্ত্রীর কাজের সুবাদে তার সঙ্গে ভিকটিমের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালে তিনি ব্রুনাই চলে গেলে ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে।

দেলোয়ার মিজি ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। দেশে আসার পর তিনি ভিকটিম নিলুফার সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক করেন। এরপর নিলুফা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তিনি নিলুফাকে বিয়ে করবেন বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকলে নিলুফা তার বাড়িতে গিয়ে উঠবে বলে হুমকি দিতে থাকেন। দেলোয়ার মিজির বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হলে ভিকটিম নিলুফা সেখানে গিয়ে সম্পর্কের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন।

দেলোয়ার মিজি তাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেন এবং বিদেশ যাওয়ার আগেই তাকে বিয়ে করে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। নিলুফা ১৩ বছরের বড় হওয়ায় দেলোয়ার মিজি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। মানসম্মানের কথা চিন্তা করে নিলুফাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১৬ জুন দেলোয়ার নিলুফাকে বিয়ের কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য লঞ্চে রওনা দেন। ভিকটিমের প্রতিবেশী মুদির দোকানদার জাহাঙ্গীরের নাম এবং ভিকটিমের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে লঞ্চের কেবিন বুকিং করেন।

নিলুফাকে হত্যা করে দায় জাহাঙ্গীরের ওপর সুকৌশলে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি জাহাঙ্গীরের নাম ব্যবহার করেন। কারণ তিনি জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ভিকটিমের সখ্য থাকার বিষয়টি জানতেন। পুলিশের সন্দেহ এড়ানোর জন্য দেলোয়ার তার নিজের মোবাইলটিও বাড়িতে রেখে আসেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী দেলোয়ার এবং নিলুফা ১৬ জুন রাতে চাঁদপুর থেকে মিতালি-৭ লঞ্চের তৃতীয় তলার এস-৩০৯ নম্বর কেবিনে ওঠেন। লঞ্চ ছাড়ার পর রাত ১২টার দিকে তিনি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিলুফাকে ধর্ষণ করেন। রাত দেড়টার দিকে বিয়ের কথা নিয়ে নিলুফার সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তিনি নিলুফার গলা চেপে ধরেন। পরে তার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ভিকটিমের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ভিকটিমের মোবাইলে থাকায় দেলোয়ার ভিকটিমের দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে বিদেশ চলে যান। দেশে ফেরার সময় সেগুলো সঙ্গে আনেননি দেলোয়ার। যেহেতু সেই মোবাইলগুলো উদ্ধার করা যায়নি, সেই আলামতও উদ্ধার করা যায়নি। দেলোয়ার মিজিকে আদালতে সোপর্দ করা হলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বিজনেস আওয়ার/১২ অক্টোবর, ২০২৩/এএইচএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: