ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে ফিরেই লাগামহীন বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস, মুন্নু ফেব্রিকসের শেয়ার দর। ব্যবসায় বড় পতনের পরেও মূল মার্কেটে ফেরার মাত্র অর্ধেক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিগুলোর গড় শেয়ার দর বেড়েছে ২৪৩ শতাংশ করে। যার পেছনে কোন কারন খুজেঁ পায়নি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনায় গত ১৩ জুন ওটিসি থেকে ফেরা ৪টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন মূল মার্কেটে শুরু হয়। যার পর থেকেই টানা দর বাড়তে থাকে কোম্পানিগুলো। এরমধ্যে কোম্পানিগুলোর ব্যবসার পতনের খবর প্রকাশও তাতে বাধা হয়ে দাড়াঁতে পারেনি। এমনকি দর বৃদ্ধির পেছনে কোন কারন নেই বলে ডিএসই থেকে সচেতনতামূলক তথ্য প্রকাশের পরে টানা দর বাড়তে থাকে।
এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ২০০ শতাংশের বেশি করে দর বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক মনে করছেন না বাজার সংশ্লিষ্টরাও। তাদের মতে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্ধেক মাসের ব্যবধানে ২০০ শতাংশের বেশি দর পাওয়া সম্ভব না। নিশ্চয় এর পেছনে কোন একটি গোষ্ঠী কাজ করছে। যা স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির সার্ভেল্যান্স চেক করলেই বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, অর্ধেক মাসের ব্যবধানে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব না। এছাড়া ব্যবসায় পতন সত্ত্বেও শেয়ার দর টানা বৃদ্ধি পাওয়াও স্বাভাবিক লক্ষণ না। এক্ষেত্রে কোন অনিয়ম হয়েছে কিনা, তা কমিশন খতিয়ে দেখতে পারে।
লেনদেন শুরু হওয়ার পরে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়ায় ৪ কোম্পানি নিয়ে সন্দেহ তৈরী হয় ডিএসই কর্তৃপক্ষের কাছে। যে কারনে তারা কারন অনুসন্ধান করে। কিন্তু কোম্পানি ৪টির মধ্যে ১টিরও টানা দর বৃদ্ধির পেছনে কোন কারন খুজেঁ পায়নি ডিএসই।
এ নিয়ে গত ২১ জুন মুন্নু ফেব্রিকসের শেয়ার দর বাড়ার পেছনে কোন কারন নেই বলে সচেতনতামূলক তথ্য প্রকাশ করে ডিএসই। এছাড়া ২২ জুন মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলসের দর বৃদ্ধির কারন নেই বলে জানায়।
শেয়ারবাজারের সঙ্গে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে জড়িত এক ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কোন শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি মানেই ভবিষ্যত ভয়াবহ। কারন ছাড়া যখন একটি কোম্পানির দর কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হবে, সেটা আজ বা কাল জায়গায় ফিরে আসতে হবেই। মাঝখানে দু-চারজন ফায়দা লুটে নিতে পারলেও লোকসানে পড়ে অসংখ্য সাধারন বিনিয়োগকারী।
কারসাজিতে জড়িতরা কি শাস্তির আওতায় আসবে না-
পুরো বীমা কোম্পানির শেয়ার কারসাজি শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সবার কাছেই দিনের আলোর মতো পরিস্কার ঘটনা। এছাড়া অন্যান্য খাতের আরও কয়েকটি শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তারপরেও মূল মার্কেটে ফেরা ৪ কোম্পানির বিষয়ে বিএসইসি কোন পদক্ষেপ নেবে কিনা, তা হয়তো ভবিষ্যতে নিশ্চিত করে বলা যাবে। কারন তারা এখন গোপনে কাজ করে।
কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের খুজেঁ বের করার মতো সার্ভেইল্যান্স দেশের ঊভয় স্টক এক্সচেঞ্জে থাকলেও সেটা অনেক আগে থেকেই নিস্ক্রিয় বলা যায়। স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে কারসাজিকারদের খুজেঁ বের করে কোন শাস্তি দেওয়ার মতো ঘটনা আছে কিনা, তা জানা নেই। এক্ষেত্রে অবশ্য তাদের সেই সক্ষমতা বা সুযোগ আছে কিনা, সেটাও প্রশ্নের দাবি রাখে।
তবে বিএসইসির এই ক্ষমতা থাকলেও তারা এখন ভিন্ন পথে। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারন অনুসন্ধানে প্রকাশে অনুসন্ধান করতে গেলেই নাকি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেকারনে তারা এখন গোপনে করে বলে দাবি। কিন্তু শাস্তি প্রদান কি গোপনে সম্ভব হবে? তখন কি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।
নিম্নে ওটিসি থেকে ফেরা ৪ কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | ওটিসি থেকে ফেরার দর | ৪ জুলাইয়ের দর | বৃদ্ধির হার |
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং | ১৬ টাকা | ৫৯.৬০ টাকা | ২৭৩% |
তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস | ১২ টাকা | ৪৪.৫০ টাকা | ২৭১% |
মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং | ৫০ টাকা | ১৬০.৩০ টাকা | ২২১% |
মুন্নু ফেব্রিকস | ১০ টাকা | ৩০.৬০ টাকা | ২০৬% |
গড় দর বৃদ্ধি | ২৪৩% |
এই অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় হয়েছে বড় পতন। ৪টি কোম্পানির মধ্যে ৩টিরই মুনাফা তলানিতে নেমে এসেছে। বাকি ১টি কোম্পানির মুনাফা কিছুটা বেড়েছে। তবে ব্যবসার এই পতন বাধা হয়ে দাড়াঁতে পারেনি। যদিও যেকোন কোম্পানির দর উত্থান-পতনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারন হওয়ার কথা ব্যবসায়িক অবস্থা। তবে সেটা সম্ভব, যদি গেম্বলাররা কৃত্রিমভাবে না বাড়ায়।
নিম্নে কোম্পানিগুলোর শেয়ারপ্রতি মুনাফার (ইপিএস) তথ্য তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | ২০-২১ অর্থবছরের ৯ মাসের ইপিএস (টাকা) | ১৯-২০ অর্থবছরের ৯ মাসের ইপিএস (টাকা) | হ্রাস-বৃদ্ধির হার |
মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং | ০.২৮ | ৫.০৬ | (৯৪%) |
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং | ০.৪৪ | ৩.৫৩ | (৮৮%) |
মুন্নু ফেব্রিকস | ০.০৪ | ০.০৬ | (৩৩%) |
তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস | ০.৯৮ | ০.৮১ | ২১% |
কতটা ঝুঁকিতে বিনিয়োগ-
ব্যবসায় এই পতন কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে অতি ঝুঁকিতে নিয়ে গেছে। যা কোম্পানিগুলোর মূল্য-আয় অনুপাত (পি/ই) দেখলেই সহজে বোঝা যায়। যে কারনে ৪টির মধ্যে ৩টি কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় মার্জিণ ঋণ বন্ধ হয়ে গেছে।
যেখানে ৪০ পিই-কে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় মার্জিণ ঋণ বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেখানে মুন্নু ফেব্রিকসের পিই ৫৭৩.৭৫, মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের পিই ৪২৯.৩৮ ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের পিই ১০১.৫৯।
অর্থাৎ মুন্নু ফেব্রিকস থেকে বিনিয়োগ ফেরত পেতে অপেক্ষা করতে হবে ৫৭৩.৭৫ বছর। এছাড়া মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে ৪২৯.৩৮ বছর ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং থেকে বিনিয়োগ ফেরতে ১০১.৫৯ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
তবে মৌলভিত্তির হিসাবের বাহিরে গিয়ে কারসাজির মাধ্যমে কেউ কেউ দ্রুত বিনিয়োগ ফেরত পেতে পারে। সেক্ষেত্রে জুয়ার ন্যায় বাজি ধরার মতো হবে। এতে একটি পক্ষ হারবে এবং অপরপক্ষ জিতবে।
নিম্নে কোম্পানিগুলোর পিই এর তথ্য তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | পিই |
মুন্নু ফেব্রিকস | ৫৭৩.৭৫ |
মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং | ৪২৯.৩৮ |
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং | ১০১.৫৯ |
তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস | ৩৪.০৬ |
যে কারনে টানা দর বৃদ্ধি সহজ হচ্ছে-
মূল মার্কেটে ফেরা কোম্পানিগুলোর টানা বা অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির পেছনে স্বল্প পরিশোধিত মূলধন একটি কারন হয়ে থাকতে পারে। পরিশোধিত মূলধন কম হলে সহজেই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করা যায়। এতে করে দর বাড়ে দ্রুত।
কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন
কোম্পানির নাম | পরিশোধিত মূলধন (কোটি টাকা) |
মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং | ৩.২৯ |
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং | ৩.৭৩ |
তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলস | ৩০.০৭ |
মুন্নু ফেব্রিকস | ১১৫ |
আরও পড়ুন……
এমারেল্ড অয়েলের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে জাপানের মিনোরি
ব্যাংকের নিট মুনাফা ৭ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, শীর্ষে ডাচ-বাংলা
বিজনেস আওয়ার/০৫ জুলাই, ২০২১/আরএ
One thought on “ওটিসি থেকে ফেরা ৪ কোম্পানির অর্ধেক মাসেই গড়ে ২৪৩ শতাংশ করে দর বৃদ্ধি”