ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

১৮ কোটি টাকার সোনালি পেপারের ঋণ নিয়ে ৫৬ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ

শেয়ারবাজারের চলমান উত্থানে শেয়ার ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছে স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের সোনালি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস কর্তৃপক্ষ। তারা ১৮ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানিটির জন্য ঋণ নিয়ে ৫৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে শেয়ারবাজারে। যা থেকে কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২১) বড় মুনাফাও অর্জন হয়েছে। অনেকটা শেয়ার ব্যবসা দিয়েই কোম্পানিটির ওইসময়ে মুনাফা হয়েছে। তবে এই বাজারে মুনাফার পাশাপাশি লোকসানের ঝুকিঁও আছে। যা গত ৭ কার্যদিবসের (১১-১৯ অক্টোবর) পতনেই বিনিয়োগকারীদের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া তার প্রমাণ। তাই শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা অর্জনের ১ম প্রান্তিকের ধারা যে ২য় প্রান্তিকেও থাকবে, তা নিশ্চিত করা কঠিন। তাই মূল ব্যবসার বাহিরে গিয়ে শেয়ার ব্যবসা থেকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারন করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছরে কয়েকটি কোম্পানির মুনাফায় ব্যাপক উত্থানের কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা। প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মুনাফায় ৩৪২ শতাংশ উত্থানের পেছনে যেমন প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা, একইভাবে রয়েছে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ৯০০ শতাংশ উত্থানের ক্ষেত্রেও। যা সোনালি পেপারেও একই কারনে হয়েছে।

অথচ ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনালি পেপারের মূল ব্যবসা হচ্ছে ডুপ্লেক্স পেপার বোর্ড, নিউজ প্রিন্ট ও হোয়াইট পেপারস তৈরী করা। যা বিক্রি থেকে মুনাফা অর্জন করা। যে কোম্পানিটি ১৯৮৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও পরবর্তীতে মন্দা ব্যবসার কারনে তালিকাচ্যুত করা হয়। তবে গত বছরের ১৫ জুন পূণ:তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

দেখা গেছে, সোনালি পেপারের আগের বছরের একইসময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে মুনাফা বেড়েছে প্রায় ৯৬০ শতাংশ। যার পুরোটাই এসেছে শেয়ার ব্যবসা থেকে। এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা থেকে যেকোন সময় হোচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেয়ারটির দর বেড়েই চলেছে। এছাড়া গত ৭ কার্যদিবসের পতনে অন্যসব বিনিয়োগকারীর ন্যায় সোনালি পেপারেরও শেয়ার ব্যবসা থেকে বড় লোকসানের শঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন……
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের নিট মুনাফার ৬৪ শতাংশ এসেছে শেয়ার ব্যবসা থেকে
প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূল ব্যবসায় লোকসান হলেও শেয়ারবাজার দিয়ে বড় মুনাফা

শেয়ারবাজারের দীর্ঘ অভিজ্ঞ এক ট্রেকহোল্ডার বিজনেস আওয়ারকে বলেন, মূল ব্যবসাকে বাদ দিয়ে কোন কোম্পানির শেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক লক্ষণ না। কিন্তু অনেক কোম্পানিতেই এমনটি হচ্ছে। এছাড়া ‘এ’ কোম্পানি থেকে ‘বি’ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ওই কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধি এবং ‘বি’ কোম্পানি থেকে ‘এ’ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ওই কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধির মতো কারসাজির ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে অনেকটা পরস্পর যোগসাজোশে এক কোম্পানি আরেক কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধিতে দায়িত্ব পালন করছে। যা দীর্ঘমেয়াদি শেয়ারবাজারের উন্নয়নের পথে বাধাঁ।

তিনি বলেন, মূল ব্যবসার পরিবর্তে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সাময়িক লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব না। এখানে রাতারাতি যেমন লাভ করা যায়, তেমনি রাতারাতি লোকসানও হয়। ওইসময় কোম্পানিকে লোকসানে পতিত হতে হবে। অতিত অভিজ্ঞতা এমনটিই বলে। তাই শেয়ারবাজারে একটি কোম্পানির কিছু বিনিয়োগ হতে পারে, কিন্তু মূল ব্যবসার থেকে বেশি না। যদি এমনটি কোন কোম্পানিতে হয়, সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরকে সচেতন হতে হবে।

স্বল্প মূলধনীর সোনালি পেপারের ব্যবসাও ছোট। এছাড়া মুনাফাও আহামরি কিছু হয় না। কিন্তু গত কয়েক মাসে শেয়ারটির দর উঠে গেছে অন্য উচ্চতায়। গত ২৭ জুনের ১৯৭.৪০ টাকার শেয়ারটি ১৯ অক্টোবর লেনদেন শেষে বেড়ে দাড়িঁয়েছে ৫৫৬.৫০ টাকায়। এক্ষেত্রে দর বেড়েছে ৩৫৯.১০ টাকা বা ১৮২ শতাংশ।

অন্যসব কোম্পানির ন্যায় সোনালি পেপারের শেয়ারবাজারের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারন হিসেবে রয়েছে গত কয়েক মাস ধরে শেয়ারবাজার টানা উত্থান। এরমধ্যে গত ৬ মাসের (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২১) ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইএক্স) মূল্যসূচক বা মানদণ্ড বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। যা দেশের শেয়ারবাজারকে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সূচকের সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটিজের দর বা বাজার মূলধনও ইতিহাসের সর্বোচ্চতে উঠে আসে। এই উত্থান অনেক কোম্পানি মূল ব্যবসাকে পাশ কাটিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে সক্ষম হয়েছে।

শেয়ার ব্যবসায় ঝুকেঁ পড়ার কারন হিসেবে সোনালি পেপারের সচিব রাশিদুল ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, করোনার কারনে সব ব্যবসাইতো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আমাদের ম্যানেজমেন্ট চিন্তা করছে শেয়ারবাজার থেকে যদি কিছুটা ঝুঁকি লাঘব করা যায় বা সুবিধা নেওয়া যায়, এজন্যই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে।

সোনালি পেপারের চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে নিট মুনাফা হয়েছে ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। যে কোম্পানিটি শেয়ার ব্যবসা থেকে মুনাফা করেছে ১১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। শেয়ারবাজার থেকে এই মুনাফা না করলে, তলানিতে থাকত ইপিএস।

কোম্পানিটির অনিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব অনুযায়ি, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য বিক্রি হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৩১ কোটি ৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে বিক্রি বেড়েছে ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বা ২৮ শতাংশ।

তবে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ৯৬০ শতাংশ। যা ওই ২৮ শতাংশ বিক্রি বৃদ্ধি দিয়ে সম্ভব হয়নি। এতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে শেয়ারবাজার থেকে বড় ক্যাপিটাল গেইন অর্জন।

দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৬.৬৬ টাকা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৬৩ টাকা। এ হিসাবে মুনাফা বেড়েছে ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা বা ৯৬০ শতাংশ।

এর পেছনে প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা থেকে বড় মুনাফা। কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে শেয়ার ব্যবসায় সিকিউরিটিজ বিক্রি থেকে (রিয়ালাইজড গেইন) মুনাফা হয়েছে ১০ কোটি ৬১ লাখ টাকা ও আনরিয়েলাইজড মুনাফা হয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে ছিল শূন্য।

শেয়ারবাজার থেকে এমন মুনাফা পেতে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন ২১) বিনিয়োগে শুরু করে সোনালি পেপার কর্তৃপক্ষ। তারা ওই প্রান্তিকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ৪৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যা চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে আরও ১১ কোটি ৬২ লাখ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩০ সেপ্টেম্বর বেড়ে দাড়িঁয়েছে ৫৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকায়।

এই বিনিয়োগ করতে গিয়ে উচ্চ সুদের মার্জিন ঋণে জড়িঁয়েছে সোনালি পেপার। যে ঋণের কবলে ২০১০ সালের ধসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বিনিয়োগকারীরা। সোনালি পেপারের দুটি বিও হিসাবেই মার্জিন ঋণ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের পোর্টফোলিওতে ৮ কোটি ৬ লাখ টাকা ও ইবিএল সিকিউরিটিজের পোর্টফোলিওতে ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার মার্জিন নেওয়া হয়েছে।

মার্জিন ছাড়াও ১৮ কোটি টাকার সোনালি পেপার আরও প্রায় ৯৪ কোটি টাকার ব্যাংখ ঋণে জর্জরিত। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির কাছে মধুমতি ব্যাংক ও পূবালি ব্যাংকের কারেন্ট পোরশনসহ দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ দাড়িঁয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক দুটির কাছে স্বল্পমেয়াদি আরও ৫০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।

মুনাফায় বড় উত্থানের কারন হিসেবে সোনালি পেপার কর্তৃপক্ষ স্টক এক্সচেঞ্জকে বিক্রি ও অন্যান্য আয় বৃদ্ধি এবং সুদজনিত ব্যয় কমাকে কারন হিসেবে জানান। যা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়।

বিজনেস আওয়ার/২১ অক্টোবর, ২০২১/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

6 thoughts on “১৮ কোটি টাকার সোনালি পেপারের ঋণ নিয়ে ৫৬ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

১৮ কোটি টাকার সোনালি পেপারের ঋণ নিয়ে ৫৬ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ

পোস্ট হয়েছে : ১০:১৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১

শেয়ারবাজারের চলমান উত্থানে শেয়ার ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছে স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের সোনালি পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস কর্তৃপক্ষ। তারা ১৮ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানিটির জন্য ঋণ নিয়ে ৫৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে শেয়ারবাজারে। যা থেকে কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২১) বড় মুনাফাও অর্জন হয়েছে। অনেকটা শেয়ার ব্যবসা দিয়েই কোম্পানিটির ওইসময়ে মুনাফা হয়েছে। তবে এই বাজারে মুনাফার পাশাপাশি লোকসানের ঝুকিঁও আছে। যা গত ৭ কার্যদিবসের (১১-১৯ অক্টোবর) পতনেই বিনিয়োগকারীদের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া তার প্রমাণ। তাই শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা অর্জনের ১ম প্রান্তিকের ধারা যে ২য় প্রান্তিকেও থাকবে, তা নিশ্চিত করা কঠিন। তাই মূল ব্যবসার বাহিরে গিয়ে শেয়ার ব্যবসা থেকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারন করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছরে কয়েকটি কোম্পানির মুনাফায় ব্যাপক উত্থানের কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা। প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মুনাফায় ৩৪২ শতাংশ উত্থানের পেছনে যেমন প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা, একইভাবে রয়েছে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ৯০০ শতাংশ উত্থানের ক্ষেত্রেও। যা সোনালি পেপারেও একই কারনে হয়েছে।

অথচ ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনালি পেপারের মূল ব্যবসা হচ্ছে ডুপ্লেক্স পেপার বোর্ড, নিউজ প্রিন্ট ও হোয়াইট পেপারস তৈরী করা। যা বিক্রি থেকে মুনাফা অর্জন করা। যে কোম্পানিটি ১৯৮৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও পরবর্তীতে মন্দা ব্যবসার কারনে তালিকাচ্যুত করা হয়। তবে গত বছরের ১৫ জুন পূণ:তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

দেখা গেছে, সোনালি পেপারের আগের বছরের একইসময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে মুনাফা বেড়েছে প্রায় ৯৬০ শতাংশ। যার পুরোটাই এসেছে শেয়ার ব্যবসা থেকে। এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা থেকে যেকোন সময় হোচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেয়ারটির দর বেড়েই চলেছে। এছাড়া গত ৭ কার্যদিবসের পতনে অন্যসব বিনিয়োগকারীর ন্যায় সোনালি পেপারেরও শেয়ার ব্যবসা থেকে বড় লোকসানের শঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন……
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের নিট মুনাফার ৬৪ শতাংশ এসেছে শেয়ার ব্যবসা থেকে
প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের মূল ব্যবসায় লোকসান হলেও শেয়ারবাজার দিয়ে বড় মুনাফা

শেয়ারবাজারের দীর্ঘ অভিজ্ঞ এক ট্রেকহোল্ডার বিজনেস আওয়ারকে বলেন, মূল ব্যবসাকে বাদ দিয়ে কোন কোম্পানির শেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক লক্ষণ না। কিন্তু অনেক কোম্পানিতেই এমনটি হচ্ছে। এছাড়া ‘এ’ কোম্পানি থেকে ‘বি’ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ওই কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধি এবং ‘বি’ কোম্পানি থেকে ‘এ’ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ওই কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধির মতো কারসাজির ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে অনেকটা পরস্পর যোগসাজোশে এক কোম্পানি আরেক কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধিতে দায়িত্ব পালন করছে। যা দীর্ঘমেয়াদি শেয়ারবাজারের উন্নয়নের পথে বাধাঁ।

তিনি বলেন, মূল ব্যবসার পরিবর্তে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সাময়িক লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব না। এখানে রাতারাতি যেমন লাভ করা যায়, তেমনি রাতারাতি লোকসানও হয়। ওইসময় কোম্পানিকে লোকসানে পতিত হতে হবে। অতিত অভিজ্ঞতা এমনটিই বলে। তাই শেয়ারবাজারে একটি কোম্পানির কিছু বিনিয়োগ হতে পারে, কিন্তু মূল ব্যবসার থেকে বেশি না। যদি এমনটি কোন কোম্পানিতে হয়, সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরকে সচেতন হতে হবে।

স্বল্প মূলধনীর সোনালি পেপারের ব্যবসাও ছোট। এছাড়া মুনাফাও আহামরি কিছু হয় না। কিন্তু গত কয়েক মাসে শেয়ারটির দর উঠে গেছে অন্য উচ্চতায়। গত ২৭ জুনের ১৯৭.৪০ টাকার শেয়ারটি ১৯ অক্টোবর লেনদেন শেষে বেড়ে দাড়িঁয়েছে ৫৫৬.৫০ টাকায়। এক্ষেত্রে দর বেড়েছে ৩৫৯.১০ টাকা বা ১৮২ শতাংশ।

অন্যসব কোম্পানির ন্যায় সোনালি পেপারের শেয়ারবাজারের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারন হিসেবে রয়েছে গত কয়েক মাস ধরে শেয়ারবাজার টানা উত্থান। এরমধ্যে গত ৬ মাসের (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২১) ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইএক্স) মূল্যসূচক বা মানদণ্ড বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। যা দেশের শেয়ারবাজারকে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সূচকের সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটিজের দর বা বাজার মূলধনও ইতিহাসের সর্বোচ্চতে উঠে আসে। এই উত্থান অনেক কোম্পানি মূল ব্যবসাকে পাশ কাটিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে সক্ষম হয়েছে।

শেয়ার ব্যবসায় ঝুকেঁ পড়ার কারন হিসেবে সোনালি পেপারের সচিব রাশিদুল ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, করোনার কারনে সব ব্যবসাইতো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আমাদের ম্যানেজমেন্ট চিন্তা করছে শেয়ারবাজার থেকে যদি কিছুটা ঝুঁকি লাঘব করা যায় বা সুবিধা নেওয়া যায়, এজন্যই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে।

সোনালি পেপারের চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে নিট মুনাফা হয়েছে ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। যে কোম্পানিটি শেয়ার ব্যবসা থেকে মুনাফা করেছে ১১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। শেয়ারবাজার থেকে এই মুনাফা না করলে, তলানিতে থাকত ইপিএস।

কোম্পানিটির অনিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব অনুযায়ি, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য বিক্রি হয়েছে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৩১ কোটি ৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে বিক্রি বেড়েছে ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বা ২৮ শতাংশ।

তবে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ৯৬০ শতাংশ। যা ওই ২৮ শতাংশ বিক্রি বৃদ্ধি দিয়ে সম্ভব হয়নি। এতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে শেয়ারবাজার থেকে বড় ক্যাপিটাল গেইন অর্জন।

দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয়েছে ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ৬.৬৬ টাকা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৬৩ টাকা। এ হিসাবে মুনাফা বেড়েছে ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা বা ৯৬০ শতাংশ।

এর পেছনে প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে শেয়ার ব্যবসা থেকে বড় মুনাফা। কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে শেয়ার ব্যবসায় সিকিউরিটিজ বিক্রি থেকে (রিয়ালাইজড গেইন) মুনাফা হয়েছে ১০ কোটি ৬১ লাখ টাকা ও আনরিয়েলাইজড মুনাফা হয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে ছিল শূন্য।

শেয়ারবাজার থেকে এমন মুনাফা পেতে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন ২১) বিনিয়োগে শুরু করে সোনালি পেপার কর্তৃপক্ষ। তারা ওই প্রান্তিকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ৪৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যা চলতি অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকে আরও ১১ কোটি ৬২ লাখ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩০ সেপ্টেম্বর বেড়ে দাড়িঁয়েছে ৫৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকায়।

এই বিনিয়োগ করতে গিয়ে উচ্চ সুদের মার্জিন ঋণে জড়িঁয়েছে সোনালি পেপার। যে ঋণের কবলে ২০১০ সালের ধসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বিনিয়োগকারীরা। সোনালি পেপারের দুটি বিও হিসাবেই মার্জিন ঋণ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের পোর্টফোলিওতে ৮ কোটি ৬ লাখ টাকা ও ইবিএল সিকিউরিটিজের পোর্টফোলিওতে ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার মার্জিন নেওয়া হয়েছে।

মার্জিন ছাড়াও ১৮ কোটি টাকার সোনালি পেপার আরও প্রায় ৯৪ কোটি টাকার ব্যাংখ ঋণে জর্জরিত। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির কাছে মধুমতি ব্যাংক ও পূবালি ব্যাংকের কারেন্ট পোরশনসহ দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ দাড়িঁয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক দুটির কাছে স্বল্পমেয়াদি আরও ৫০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।

মুনাফায় বড় উত্থানের কারন হিসেবে সোনালি পেপার কর্তৃপক্ষ স্টক এক্সচেঞ্জকে বিক্রি ও অন্যান্য আয় বৃদ্ধি এবং সুদজনিত ব্যয় কমাকে কারন হিসেবে জানান। যা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়।

বিজনেস আওয়ার/২১ অক্টোবর, ২০২১/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: