ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিক্রি দ্বিগুণ হলেও উৎপাদন ব্যয় কমেছে: প্রতিযোগী কোম্পানির অবস্থা ভিন্ন

লোকসানি ইয়াকিন পলিমারের চলতি অর্থবছরের ২য় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২১) আর্থিক হিসাব প্রকাশকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই শেয়ার দর বাড়তে থাকে। ওই প্রান্তিকে কোম্পানির মুনাফায় বড় উত্থান হবে, এমন খবর আগেই ছড়িয়ে দেওয়ায় এমনটি হয়। যা কোম্পানির গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রকাশিত আর্থিক হিসাবে মুনাফার উত্থানের সেই খবরের সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই মুনাফা কতটুকু সঠিক, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কোম্পানিটির বিক্রি দ্বিগুণ হলেও ওই বিক্রিত পণ্য উৎপাদনে ব্যয় আগের থেকে কম দেখানোয়, সেই প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। এতে আরও বড় ভূমিকা রেখেছে প্রতিযোগী ব্যবসায়িদের উৎপাদন ব্যয়ের হার বৃদ্ধি।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটি থেকে পিপি ওভেন ব্যাগ, বিওপিপি ব্যাগ, জাম্বো/এফআইবিসি ব্যাগ এবং বিভিন্ন রঙ্গের এইচডিপিই/এলডিপিই লাইনার উৎপাদন ও বাজারজাতকরন করা হয়। এ কোম্পানিটির দেশে বিভিন্ন প্রতিযোগী কোম্পানি রয়েছে। এ তালিকায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ ও মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ রয়েছে।

একই শ্রেণীর পণ্য উৎপাদন ও বাজারবাজাতকরন করে থাকে কোম্পানিগুলো। এরমধ্যে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ও সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজের বিক্রির তুলনায় উৎপাদন ব্যয়ের হার বেড়েছে। সেখানে ইয়াকিন পলিমারের বিক্রি দ্বিগুণ সত্ত্বেও শুধু উৎপাদন ব্যয়ের হার না, মোট উৎপাদন ব্যয়ই কমে গেছে বলে আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। তবে আরেক প্রতিযোগি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২১ সালের মার্চের পরে আর্থিক হিসাব প্রকাশ বন্ধ থাকায়, ওই কোম্পানির অবস্থা জানা যায়নি।

শেয়ারবাজারে নিরীক্ষত আর্থিক হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন রয়েছে। সেখানে অনিরীক্ষিত কোয়ার্টারলি (প্রান্তিক) আর্থিক হিসাব বিশ্বাস করা যে কতটা কঠিন, তা সাধারন বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবেই টের পান। এই বাজারে কোম্পানিগুলোর অনিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব ম্যানেজমেন্টের সুবিধামতো তৈরী করা হয়। যে কারনে অনেক কোম্পানির এক প্রান্তিকের সঙ্গে আরেক প্রান্তিকের ব্যবসার কোন মিল থাকে না। ফলে প্রতারণার ফাদেঁ পড়তে হয় সাধারন বিনিয়োগকারীদের।

এ বিষয়ে দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ মোঃ শায়খুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিক্রি দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও কোন কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় কমে আসার বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা না। এটা আরও বেশি অস্বাভাবিক, যখন একই খাতের অন্যসব কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ের হারই বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন ম্যানুপুলুটেড অ্যাকাউন্টস তৈরী করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

আইসিএমএবির এই সাবেক সভাপতি বলেন, অনিরীক্ষিত (আনঅডিটেড) বলে কোন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অসত্য অ্যাকাউন্টস বানাতে পারেন, এমনটি না। কারন এই অ্যাকাউন্টসের উপর ভিত্তি করেও বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তাই অস্বাভাবিক আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা কোম্পানিগুলোর বিষয়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অন্যথায় সাধারন বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হতেই থাকবেন।

ইয়াকিন পলিমারের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) নিট লোকসান হয়েছিল ৪ কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৫৬ টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে নিট মুনাফা দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৫০ টাকা। যা দেখাতে গিয়ে বিক্রি বেড়েছে বললেও উৎপাদনে ব্যয় কমিয়ে দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং যে অন্যতম প্রধান সমস্যা, এটা একবাক্যে স্বীকার করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানির উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা সরাসরি শেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে। যে কারনে অনেক কোম্পানির প্রান্তিক আর্থিক হিসাবগুলো তাদের শেয়ার ব্যবসার সুবিধার্থে প্রস্তুত করা হয়। এক্ষেত্রে কোন প্রান্তিকে মুনাফা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো হয়। যেটা পুরো বছরের হিসাবে কিংবা এক প্রান্তিকের হিসাব আরেক প্রান্তিকের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখানো হয়।

আরও পড়ুন….
ইয়াকিন পলিমারে ইনসাইডার ট্রেডিং
সাফকো স্পিনিংয়ের বিক্রি ১১৮% বাড়লেও উৎপাদনে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খরচ কমেছে

দেখা গেছে, ইয়াকিন পলিমারের চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) ১১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে বিক্রি বেড়েছে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার বা ৯৬ শতাংশ।

এই পণ্য উৎপাদনে কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের ৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ব্যয় এ বছর কমিয়ে ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ বিক্রি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও উৎপাদন ব্যয় কমেছে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার বা ২৭ শতাংশ। অন্যভাবে কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের বিক্রির তুলনায় ১৩৫ শতাংশের উৎপাদন ব্যয় এ বছর দেখানো হয়েছে ৫০ শতাংশ।

এই অস্বাভাবিক হারে উৎপাদন ব্যয় কমে আসার পরেও আর্থিক হিসাবে এ বিষয়ে কোন বিস্তারিত নোটস দেওয়া হয়নি। এমনকি অন্য কোন বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়ে নোটস দেওয়া হয়নি।

অথচ একই খাতের এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এমনকি উৎপাদন ব্যয়ের হারও বেড়েছে।

দেখা গেছে, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ব্যয় হয়েছিল ৮৭ কোটি ৫ লাখ টাকা বা ৯০%। যা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১১১ কোটি ১ লাখ টাকা বা ৯১%।

এদিকে খান ব্রার্দার্স পিপি ওভেন ব্যাগের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১০ কোটি ১১ লাখ টাকার বিক্রি করা পণ্য উৎপাদনে ব্যয় হয়েছিল ৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বা ৮৬%। যা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিক্রিত পণ্য উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা বা ৮৭%।

এ বিষয়ে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের সচিব তপন কুমার সরকার বিজনেস আওয়ারকে বলেন, উৎপাদন ব্যয় সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের পরেও ৭৫% এর নিচে রাখা সম্ভব না। স্ট্যান্ডার্ড উৎপাদন ব্যয় ৮০% এর উপরে। কেউ যদি ৫০% উৎপাদন ব্যয় দেখায়, তাহলে সেটা সঠিক না।

এমন অস্বাভাবিক আর্থিক হিসাবের বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস) মেনে কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব জমা ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেউ যদি হিসাব মান লঙ্ঘন করে কৃত্রিম আর্থিক হিসাব প্রকাশ করে থাকে, তাহলে কমিশন সে বিষয় খতিয়ে দেখবে।

উৎপাদন ব্যয় কমে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াকিন পলিমারের চেয়ারম্যান কাজী আনোয়ারুল হক বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আর্থিক হিসাবে এ বিষয়ে দেওয়া আছে। কিন্তু নেই এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঠিক আছে তাহলে আপনাকে আনুষ্ঠানিক লিখিত দিচ্ছি। যেটা সব জায়গায় দেওয়া হয়েছে।

এরপরে পাঠানো এক মেইলে জানানো হয়, করোনার পরিস্থিতির উন্নতিতে উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে। এছাড়া পূর্বের কিছু পুরো প্রস্তুত ও অর্ধেক প্রস্তুত পণ্য লট আকারে বিক্রি করা হয়েছে। এতে করে মুনাফা ও ইপিএস বেড়েছে। যে তথ্য এর আগে ডিএসইর ওয়েবসাইটেও গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু এই তথ্যে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক কমে আসার মতো কোন বিষয় উল্লেখ নেই। বরং উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক।

বিজনেস আওয়ার/১০ মার্চ, ২০২২/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

2 thoughts on “বিক্রি দ্বিগুণ হলেও উৎপাদন ব্যয় কমেছে: প্রতিযোগী কোম্পানির অবস্থা ভিন্ন

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

বিক্রি দ্বিগুণ হলেও উৎপাদন ব্যয় কমেছে: প্রতিযোগী কোম্পানির অবস্থা ভিন্ন

পোস্ট হয়েছে : ১২:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ ২০২২

লোকসানি ইয়াকিন পলিমারের চলতি অর্থবছরের ২য় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২১) আর্থিক হিসাব প্রকাশকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই শেয়ার দর বাড়তে থাকে। ওই প্রান্তিকে কোম্পানির মুনাফায় বড় উত্থান হবে, এমন খবর আগেই ছড়িয়ে দেওয়ায় এমনটি হয়। যা কোম্পানির গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রকাশিত আর্থিক হিসাবে মুনাফার উত্থানের সেই খবরের সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই মুনাফা কতটুকু সঠিক, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কোম্পানিটির বিক্রি দ্বিগুণ হলেও ওই বিক্রিত পণ্য উৎপাদনে ব্যয় আগের থেকে কম দেখানোয়, সেই প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। এতে আরও বড় ভূমিকা রেখেছে প্রতিযোগী ব্যবসায়িদের উৎপাদন ব্যয়ের হার বৃদ্ধি।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটি থেকে পিপি ওভেন ব্যাগ, বিওপিপি ব্যাগ, জাম্বো/এফআইবিসি ব্যাগ এবং বিভিন্ন রঙ্গের এইচডিপিই/এলডিপিই লাইনার উৎপাদন ও বাজারজাতকরন করা হয়। এ কোম্পানিটির দেশে বিভিন্ন প্রতিযোগী কোম্পানি রয়েছে। এ তালিকায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ ও মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ রয়েছে।

একই শ্রেণীর পণ্য উৎপাদন ও বাজারবাজাতকরন করে থাকে কোম্পানিগুলো। এরমধ্যে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ও সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজের বিক্রির তুলনায় উৎপাদন ব্যয়ের হার বেড়েছে। সেখানে ইয়াকিন পলিমারের বিক্রি দ্বিগুণ সত্ত্বেও শুধু উৎপাদন ব্যয়ের হার না, মোট উৎপাদন ব্যয়ই কমে গেছে বলে আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। তবে আরেক প্রতিযোগি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২১ সালের মার্চের পরে আর্থিক হিসাব প্রকাশ বন্ধ থাকায়, ওই কোম্পানির অবস্থা জানা যায়নি।

শেয়ারবাজারে নিরীক্ষত আর্থিক হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন রয়েছে। সেখানে অনিরীক্ষিত কোয়ার্টারলি (প্রান্তিক) আর্থিক হিসাব বিশ্বাস করা যে কতটা কঠিন, তা সাধারন বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবেই টের পান। এই বাজারে কোম্পানিগুলোর অনিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব ম্যানেজমেন্টের সুবিধামতো তৈরী করা হয়। যে কারনে অনেক কোম্পানির এক প্রান্তিকের সঙ্গে আরেক প্রান্তিকের ব্যবসার কোন মিল থাকে না। ফলে প্রতারণার ফাদেঁ পড়তে হয় সাধারন বিনিয়োগকারীদের।

এ বিষয়ে দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ মোঃ শায়খুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিক্রি দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও কোন কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় কমে আসার বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা না। এটা আরও বেশি অস্বাভাবিক, যখন একই খাতের অন্যসব কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ের হারই বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন ম্যানুপুলুটেড অ্যাকাউন্টস তৈরী করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

আইসিএমএবির এই সাবেক সভাপতি বলেন, অনিরীক্ষিত (আনঅডিটেড) বলে কোন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অসত্য অ্যাকাউন্টস বানাতে পারেন, এমনটি না। কারন এই অ্যাকাউন্টসের উপর ভিত্তি করেও বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তাই অস্বাভাবিক আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা কোম্পানিগুলোর বিষয়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অন্যথায় সাধারন বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হতেই থাকবেন।

ইয়াকিন পলিমারের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) নিট লোকসান হয়েছিল ৪ কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৫৬ টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে নিট মুনাফা দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৫০ টাকা। যা দেখাতে গিয়ে বিক্রি বেড়েছে বললেও উৎপাদনে ব্যয় কমিয়ে দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ইনসাইডার ট্রেডিং যে অন্যতম প্রধান সমস্যা, এটা একবাক্যে স্বীকার করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানির উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা সরাসরি শেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে। যে কারনে অনেক কোম্পানির প্রান্তিক আর্থিক হিসাবগুলো তাদের শেয়ার ব্যবসার সুবিধার্থে প্রস্তুত করা হয়। এক্ষেত্রে কোন প্রান্তিকে মুনাফা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো হয়। যেটা পুরো বছরের হিসাবে কিংবা এক প্রান্তিকের হিসাব আরেক প্রান্তিকের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখানো হয়।

আরও পড়ুন….
ইয়াকিন পলিমারে ইনসাইডার ট্রেডিং
সাফকো স্পিনিংয়ের বিক্রি ১১৮% বাড়লেও উৎপাদনে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খরচ কমেছে

দেখা গেছে, ইয়াকিন পলিমারের চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) ১১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। যার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে বিক্রি বেড়েছে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার বা ৯৬ শতাংশ।

এই পণ্য উৎপাদনে কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের ৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকার ব্যয় এ বছর কমিয়ে ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ বিক্রি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও উৎপাদন ব্যয় কমেছে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার বা ২৭ শতাংশ। অন্যভাবে কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের বিক্রির তুলনায় ১৩৫ শতাংশের উৎপাদন ব্যয় এ বছর দেখানো হয়েছে ৫০ শতাংশ।

এই অস্বাভাবিক হারে উৎপাদন ব্যয় কমে আসার পরেও আর্থিক হিসাবে এ বিষয়ে কোন বিস্তারিত নোটস দেওয়া হয়নি। এমনকি অন্য কোন বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়ে নোটস দেওয়া হয়নি।

অথচ একই খাতের এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এমনকি উৎপাদন ব্যয়ের হারও বেড়েছে।

দেখা গেছে, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ব্যয় হয়েছিল ৮৭ কোটি ৫ লাখ টাকা বা ৯০%। যা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১১১ কোটি ১ লাখ টাকা বা ৯১%।

এদিকে খান ব্রার্দার্স পিপি ওভেন ব্যাগের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১০ কোটি ১১ লাখ টাকার বিক্রি করা পণ্য উৎপাদনে ব্যয় হয়েছিল ৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বা ৮৬%। যা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিক্রিত পণ্য উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা বা ৮৭%।

এ বিষয়ে খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের সচিব তপন কুমার সরকার বিজনেস আওয়ারকে বলেন, উৎপাদন ব্যয় সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের পরেও ৭৫% এর নিচে রাখা সম্ভব না। স্ট্যান্ডার্ড উৎপাদন ব্যয় ৮০% এর উপরে। কেউ যদি ৫০% উৎপাদন ব্যয় দেখায়, তাহলে সেটা সঠিক না।

এমন অস্বাভাবিক আর্থিক হিসাবের বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস) মেনে কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব জমা ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেউ যদি হিসাব মান লঙ্ঘন করে কৃত্রিম আর্থিক হিসাব প্রকাশ করে থাকে, তাহলে কমিশন সে বিষয় খতিয়ে দেখবে।

উৎপাদন ব্যয় কমে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াকিন পলিমারের চেয়ারম্যান কাজী আনোয়ারুল হক বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আর্থিক হিসাবে এ বিষয়ে দেওয়া আছে। কিন্তু নেই এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঠিক আছে তাহলে আপনাকে আনুষ্ঠানিক লিখিত দিচ্ছি। যেটা সব জায়গায় দেওয়া হয়েছে।

এরপরে পাঠানো এক মেইলে জানানো হয়, করোনার পরিস্থিতির উন্নতিতে উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে। এছাড়া পূর্বের কিছু পুরো প্রস্তুত ও অর্ধেক প্রস্তুত পণ্য লট আকারে বিক্রি করা হয়েছে। এতে করে মুনাফা ও ইপিএস বেড়েছে। যে তথ্য এর আগে ডিএসইর ওয়েবসাইটেও গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু এই তথ্যে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক কমে আসার মতো কোন বিষয় উল্লেখ নেই। বরং উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক।

বিজনেস আওয়ার/১০ মার্চ, ২০২২/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: