ঢাকা , শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লোকসানি বিডিওয়েল্ডিংয়ের লভ্যাংশের আড়ালে ফাঁদ

  • পোস্ট হয়েছে : ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ অগাস্ট ২০২০
  • 1

রেজোয়ান আহমেদ : ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মুনাফা করেও লভ্যাংশ দেয়নি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস (বিডিওয়েল্ডিং)। কিন্তু এরপরের ২ অর্থবছরে লোকসান সত্ত্বেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য নামমাত্র বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে উৎপাদন বন্ধ থাকা এ কোম্পানির পর্ষদ। আর এই লভ্যাংশকে ঘিরে শেয়ারটি ১ মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে লোকসান কমিয়ে সংরক্ষিত আয় (রিটেইন আর্নিংস) পজিটিভ দেখানো হয়েছে। অথচ এই কোম্পানিটি আর্থিক সংকটে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত কারখানা চালু করতে পারছে না।

অতিতের ন্যায় এখনো গেম্বলারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনেক কোম্পানির পর্ষদ পিএসই এবং লভ্যাংশ ঘোষণা করার মৌখিক চুক্তি করে থাকে। যার উপর ভিত্তি করে গেম্বলাররা পিএসই বা লভ্যাংশ ঘোষণার আগে থেকেই শেয়ার দর বাড়াতে থাকে। সাধারন বিনিয়োগকারীরা যুক্ত হওয়ার পরে তারা মুনাফা নিয়ে কেটে পড়ে। অনেকটা সেরকমই হয়েছে বিডি ওয়েল্ডিংয়ে।

কয়েক দবছর ধরে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ বিডিওয়েল্ডিংয়ের। একইসঙ্গে রয়েছে লোকসানে। কিন্তু এই কোম্পানির শেয়ারটি ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লভ্যাংশ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। কোম্পানিটির লভ্যাংশ সংক্রান্ত সভা ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলেও ২৭ জুলাই থেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে। লোকসানের কোম্পানিতে পর্ষদ সভার আগে এই অস্বাভাবিক উত্থান স্বাভাবিক না বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এক্ষেত্রে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জড়িত না থাকলে এমনটি হওয়ার সুযোগ নেই।

গত ২৬ জুলাই বিডিওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার দর ছিল ১৫.৫০ টাকা। যে শেয়ারটি ১৭ আগস্ট বেড়ে দাড়িঁয়েছে ২৮ টাকায়। অর্থাৎ ২২ দিনের ব্যবধানে শেয়ারটির দর বেড়েছে ১২.৫০ টাকা বা ৮১ শতাংশ।

বিডিওয়েল্ডিংয়ের পর্ষদ এর আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ব্যবসায় লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরপরে ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ব্যবসায় লভ্যাংশ দেয়নি। এমনকি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মুনাফা সত্ত্বেও কোন লভ্যাংশ দেয়নি। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৩৬ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৮ পয়সা লোকসান সত্ত্বেও ২০১৮-১৯ এর জন্য ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। যে লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে আবার ওই ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মুনাফার উপর। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটি ৮ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা মুনাফা করায় রিটেইন আর্নিংস পজিটিভ ছিল।

বোনাস শেয়ার ঘোষণার কারন হিসেবে বিডিওয়েল্ডিং কর্তৃপক্ষ কারখানা স্থানান্তরকে উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই কারখানা স্থানান্তরে বোনাস শেয়ার দেওয়ার কোন দরকার ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই স্থানান্তর করা সম্ভব। এমন না যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মুনাফা থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়া হবে। যাতে করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুনাফা বিতরন করতে হবে না। সেই মুনাফা দিয়ে কারখানা স্থানান্তর করা হবে। কোম্পানিটি লোকসান করায় বোনাস শেয়ার না দিয়েও স্থানান্তর করা সম্ভব। বরং বোনাস শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে কোম্পানিটির উপর ভবিষ্যতে লভ্যাংশ দেওয়া কঠিন হলো।

অযৌক্তিকভাবে বোনাস শেয়ার দিয়ে মুনাফা কোম্পানিতে রেখে দেওয়া রোধ করার জন্য ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এক নির্দেশনা জারি করে। ওই নির্দেশনার ১ ধারায় বলা হয়েছে, কোন কোম্পানি বিএমআরই ছাড়া বোনাস শেয়ার দিতে পারবে না। বোনাস শেয়ার প্রদানের মাধ্যমে রেখে দেওয়া মুনাফার যথার্থ ব্যবহারের জন্য এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আর এই বাধ্যবাধকতার কারনেই কারখানা স্থানান্তরের মতো অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছে বিডি ওয়েল্ডিং কর্তৃপক্ষ।

তবে লভ্যাংশ দেওয়ার কারন হিসেবে বিজনেস আওয়ারকে ভিন্ন কথা বললেন বিডিওয়েল্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এবার লভ্যাংশ না দিলে কোম্পানিটি ওটিসিতে চলে যায়। তাহলে শেয়ারহোল্ডারদের যে ক্ষতিটা হবে, তা অকল্পনীয়। শেয়ারটির লেনদেনটাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষিত করার জন্য রিটেইন আর্নিংস থেকে বোনাস শেয়ার সুপারিশ করেছি।

শ্যামপুর সুগার মিলস, মেঘনা কনডেন্সড মিল্কসহ অনেক কোম্পানি আরও বেশি সময় ধরে লভ্যাংশ না দিয়েও ওটিসিতে যায়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা ওটিসিতে যায়নি? হয়তো ওইসব কোম্পানি নিয়মিত এজিএম করেছে। কিন্তু ডিএসইর কেতাবে যেটা দেখলাম, পরপর ৩ বছর লভ্যাংশ না দিলে অটোমেটিক্যালি ওটিসিতে চলে যাবে। এই ভয়েই শেয়ারহোল্ডারদের কথা চিন্তা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করলাম।

শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা বিজনেস আওয়ারকে বলেন, উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে ‘জেড’ ক্যাটাগরি থেকে বের হওয়ার জন্য বোনাস শেয়ার দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কারখানা স্থানান্তরের জন্য পূর্বের মুনাফা থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়ার উদ্দেশ্য ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কারখানা স্থানান্তরের জন্যতো পূর্বের মুনাফা থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়ার দরকার নেই। বোনাস না দিয়েই ওই মুনাফা দিয়ে স্থানান্তর করা সম্ভব। এখন দেখতে হবে এই লভ্যাংশকে ঘিরে শেয়ারটির অস্বাভাবিক উত্থান ঘটেছে কিনা। যদি ঘটে, তাহলে কমিশন তদন্ত করে বোনাস দেওয়ার সঠিক কারন অনুসন্ধান করতে পারে।

এদিকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে উৎপাদন বন্ধ থাকা বিডিওয়েল্ডিং কর্তৃপক্ষ বোনাস শেয়ার প্রদান করতে আর্থিক হিসাবে কারসাজিঁ করেছে। কোম্পানিটি বিগত ২ অর্থবছরে লোকসান কম দেখিয়ে সংরক্ষিত আয় (রিটেইন আর্নিংস) পজিটিভ রেখেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকেরসহ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো আর্থিক হিসাব একসাথে প্রকাশ করায় এ কারসাজি সহজ হয়েছে। অন্যথায় ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করা সম্ভব হতো না।

বিডিওয়েল্ডিংয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৭) আর্থিক হিসাব অনুযায়ি, কোম্পানিটির ওইসময় শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৫ পয়সা। উৎপাদন বন্ধ থাকার কারনে যা ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেড়ে হয় ৩২ পয়সা। যা ওই অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৭-মার্চ ১৮) আরও বেড়ে হয় ৪৬ পয়সা। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পুরো আর্থিক হিসেবে শেয়ারপ্রতি লোকসান কমিয়ে দেখিয়েছে ৩৬ পয়সা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও শেয়ারপ্রতি মুনাফা দেখিয়েছে ১০ পয়সা। অন্যথায় পূর্বের ৯ মাসের আর্থিক হিসাবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। যে কারনে ৯ মাসের তুলনায় পুরো অর্থবছরে লোকসান কমে এসেছে। যা পরবর্তী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও কমিয়ে দেখিয়েছে মাত্র ৮ পয়সা। আগের অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে মুনাফা দেখালেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আবার লোকসান দেখিয়েছে।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ যদি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক কারসাজি ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান কমিয়ে না দেখাতো, তাহলে বোনাস শেয়ার দেওয়ার মতো রিটেইন আর্নিংস থাকতো না। যাতে করে নামমাত্র বোনাস শেয়ার ঘোষণার আড়ালে শেয়ার দর বাড়ানোর গেম্বলিংটাও সম্ভব হতো না।

দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাস শেষে (মার্চ ১৮) রিটেইন আর্নিংস ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার ৬১৩ টাকা। এই রিটেইন আর্নিংস নেগেটিভ হয়ে যেত, যদি লোকসান কমিয়ে না দেখাতো। ওই অর্থবছরের ১ম ৩টি প্রান্তিকের মতো শেষ প্রান্তিকেও যদি ১৫ পয়সা লোকসান দেখাতো, তাহলে বছর শেষে এই রিটেইন আর্নিংস নেমে আসত ৬৪ লাখ ৩৮ হাজারে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একইধারায় বা যৌক্তিক লোকসান দেখালে ওই রিটেইন আর্নিংস নেগেটিভ হয়ে যেত। যাতে করে ১ শতাংশ হারে ৪২ লাখ ৯২ হাজার টাকার বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করা সম্ভব হতো না।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাসের তুলনায় পুরো বছরে লোকসান কমে আসার কারন কি জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম নুরুল ইসলাম বলেন, এটা ওপেন রিপ্লাই দেওয়া মুশকিল। এগুলাতো নিরীক্ষক ও অ্যাকাউন্টসের লোকজন যাচাই-বাছাই করে দাঁড় করায়। এখন এ বিষয়ে আমার পক্ষে বিস্তারিত বলা কঠিন। এখন বন্ধ থাকলে যা হয়, ফিক্সড খরচটাতো রয়ে গেলো। এছাড়া চিটাংগাং থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আসার সময় সকলের দেনা পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে আসছিলাম। তারপরে ঢাকাতে এসে কিছু লোকজন নিয়োগ দিয়েছিলাম। তারা বছরখানিক ছিল। এরপরে তারা আবার বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। এখন সীমিত কিছু লোকজন আছে। যাদেরকে ছাড়া যাচ্ছে না। তারা প্রতিযোগী কোম্পানির কাছে গেলে আমাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে।

তিনি বলেন, উৎপাদন চালু করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। তবে বড় সমস্যা হয়েছে ফান্ড নিয়ে। এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারলে দ্রুত উৎপাদন চালু করতে পারতাম। কিন্তু ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে বড় বাধা হচ্ছে, আইসিবির মনোনিত পরিচালকেরা যতক্ষন পর্যন্ত রাজি না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত নেওয়া যাবে না। এখন আইসিবি তাদের শেয়ারটা ট্রান্সফার করে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও কিছু আইনগত জটিলতা আছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এজিএমটা হয়ে গেলে অনেকটাই সমাধান হবে।

বিজনেস আওয়ার/১৯ আগস্ট, ২০২০/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

3 thoughts on “লোকসানি বিডিওয়েল্ডিংয়ের লভ্যাংশের আড়ালে ফাঁদ

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

লোকসানি বিডিওয়েল্ডিংয়ের লভ্যাংশের আড়ালে ফাঁদ

পোস্ট হয়েছে : ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ অগাস্ট ২০২০

রেজোয়ান আহমেদ : ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মুনাফা করেও লভ্যাংশ দেয়নি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস (বিডিওয়েল্ডিং)। কিন্তু এরপরের ২ অর্থবছরে লোকসান সত্ত্বেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য নামমাত্র বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে উৎপাদন বন্ধ থাকা এ কোম্পানির পর্ষদ। আর এই লভ্যাংশকে ঘিরে শেয়ারটি ১ মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে লোকসান কমিয়ে সংরক্ষিত আয় (রিটেইন আর্নিংস) পজিটিভ দেখানো হয়েছে। অথচ এই কোম্পানিটি আর্থিক সংকটে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত কারখানা চালু করতে পারছে না।

অতিতের ন্যায় এখনো গেম্বলারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনেক কোম্পানির পর্ষদ পিএসই এবং লভ্যাংশ ঘোষণা করার মৌখিক চুক্তি করে থাকে। যার উপর ভিত্তি করে গেম্বলাররা পিএসই বা লভ্যাংশ ঘোষণার আগে থেকেই শেয়ার দর বাড়াতে থাকে। সাধারন বিনিয়োগকারীরা যুক্ত হওয়ার পরে তারা মুনাফা নিয়ে কেটে পড়ে। অনেকটা সেরকমই হয়েছে বিডি ওয়েল্ডিংয়ে।

কয়েক দবছর ধরে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ বিডিওয়েল্ডিংয়ের। একইসঙ্গে রয়েছে লোকসানে। কিন্তু এই কোম্পানির শেয়ারটি ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লভ্যাংশ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। কোম্পানিটির লভ্যাংশ সংক্রান্ত সভা ৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলেও ২৭ জুলাই থেকে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে। লোকসানের কোম্পানিতে পর্ষদ সভার আগে এই অস্বাভাবিক উত্থান স্বাভাবিক না বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এক্ষেত্রে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জড়িত না থাকলে এমনটি হওয়ার সুযোগ নেই।

গত ২৬ জুলাই বিডিওয়েল্ডিংয়ের শেয়ার দর ছিল ১৫.৫০ টাকা। যে শেয়ারটি ১৭ আগস্ট বেড়ে দাড়িঁয়েছে ২৮ টাকায়। অর্থাৎ ২২ দিনের ব্যবধানে শেয়ারটির দর বেড়েছে ১২.৫০ টাকা বা ৮১ শতাংশ।

বিডিওয়েল্ডিংয়ের পর্ষদ এর আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ব্যবসায় লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরপরে ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ব্যবসায় লভ্যাংশ দেয়নি। এমনকি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মুনাফা সত্ত্বেও কোন লভ্যাংশ দেয়নি। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৩৬ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৮ পয়সা লোকসান সত্ত্বেও ২০১৮-১৯ এর জন্য ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। যে লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে আবার ওই ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মুনাফার উপর। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটি ৮ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা মুনাফা করায় রিটেইন আর্নিংস পজিটিভ ছিল।

বোনাস শেয়ার ঘোষণার কারন হিসেবে বিডিওয়েল্ডিং কর্তৃপক্ষ কারখানা স্থানান্তরকে উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই কারখানা স্থানান্তরে বোনাস শেয়ার দেওয়ার কোন দরকার ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই স্থানান্তর করা সম্ভব। এমন না যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মুনাফা থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়া হবে। যাতে করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুনাফা বিতরন করতে হবে না। সেই মুনাফা দিয়ে কারখানা স্থানান্তর করা হবে। কোম্পানিটি লোকসান করায় বোনাস শেয়ার না দিয়েও স্থানান্তর করা সম্ভব। বরং বোনাস শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে কোম্পানিটির উপর ভবিষ্যতে লভ্যাংশ দেওয়া কঠিন হলো।

অযৌক্তিকভাবে বোনাস শেয়ার দিয়ে মুনাফা কোম্পানিতে রেখে দেওয়া রোধ করার জন্য ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এক নির্দেশনা জারি করে। ওই নির্দেশনার ১ ধারায় বলা হয়েছে, কোন কোম্পানি বিএমআরই ছাড়া বোনাস শেয়ার দিতে পারবে না। বোনাস শেয়ার প্রদানের মাধ্যমে রেখে দেওয়া মুনাফার যথার্থ ব্যবহারের জন্য এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আর এই বাধ্যবাধকতার কারনেই কারখানা স্থানান্তরের মতো অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছে বিডি ওয়েল্ডিং কর্তৃপক্ষ।

তবে লভ্যাংশ দেওয়ার কারন হিসেবে বিজনেস আওয়ারকে ভিন্ন কথা বললেন বিডিওয়েল্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এবার লভ্যাংশ না দিলে কোম্পানিটি ওটিসিতে চলে যায়। তাহলে শেয়ারহোল্ডারদের যে ক্ষতিটা হবে, তা অকল্পনীয়। শেয়ারটির লেনদেনটাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষিত করার জন্য রিটেইন আর্নিংস থেকে বোনাস শেয়ার সুপারিশ করেছি।

শ্যামপুর সুগার মিলস, মেঘনা কনডেন্সড মিল্কসহ অনেক কোম্পানি আরও বেশি সময় ধরে লভ্যাংশ না দিয়েও ওটিসিতে যায়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা ওটিসিতে যায়নি? হয়তো ওইসব কোম্পানি নিয়মিত এজিএম করেছে। কিন্তু ডিএসইর কেতাবে যেটা দেখলাম, পরপর ৩ বছর লভ্যাংশ না দিলে অটোমেটিক্যালি ওটিসিতে চলে যাবে। এই ভয়েই শেয়ারহোল্ডারদের কথা চিন্তা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করলাম।

শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা বিজনেস আওয়ারকে বলেন, উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে ‘জেড’ ক্যাটাগরি থেকে বের হওয়ার জন্য বোনাস শেয়ার দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কারখানা স্থানান্তরের জন্য পূর্বের মুনাফা থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়ার উদ্দেশ্য ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কারখানা স্থানান্তরের জন্যতো পূর্বের মুনাফা থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়ার দরকার নেই। বোনাস না দিয়েই ওই মুনাফা দিয়ে স্থানান্তর করা সম্ভব। এখন দেখতে হবে এই লভ্যাংশকে ঘিরে শেয়ারটির অস্বাভাবিক উত্থান ঘটেছে কিনা। যদি ঘটে, তাহলে কমিশন তদন্ত করে বোনাস দেওয়ার সঠিক কারন অনুসন্ধান করতে পারে।

এদিকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে উৎপাদন বন্ধ থাকা বিডিওয়েল্ডিং কর্তৃপক্ষ বোনাস শেয়ার প্রদান করতে আর্থিক হিসাবে কারসাজিঁ করেছে। কোম্পানিটি বিগত ২ অর্থবছরে লোকসান কম দেখিয়ে সংরক্ষিত আয় (রিটেইন আর্নিংস) পজিটিভ রেখেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকেরসহ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো আর্থিক হিসাব একসাথে প্রকাশ করায় এ কারসাজি সহজ হয়েছে। অন্যথায় ১ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করা সম্ভব হতো না।

বিডিওয়েল্ডিংয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১ম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৭) আর্থিক হিসাব অনুযায়ি, কোম্পানিটির ওইসময় শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৫ পয়সা। উৎপাদন বন্ধ থাকার কারনে যা ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেড়ে হয় ৩২ পয়সা। যা ওই অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৭-মার্চ ১৮) আরও বেড়ে হয় ৪৬ পয়সা। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পুরো আর্থিক হিসেবে শেয়ারপ্রতি লোকসান কমিয়ে দেখিয়েছে ৩৬ পয়সা। অর্থাৎ ওই অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও শেয়ারপ্রতি মুনাফা দেখিয়েছে ১০ পয়সা। অন্যথায় পূর্বের ৯ মাসের আর্থিক হিসাবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। যে কারনে ৯ মাসের তুলনায় পুরো অর্থবছরে লোকসান কমে এসেছে। যা পরবর্তী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও কমিয়ে দেখিয়েছে মাত্র ৮ পয়সা। আগের অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে মুনাফা দেখালেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আবার লোকসান দেখিয়েছে।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ যদি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক কারসাজি ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান কমিয়ে না দেখাতো, তাহলে বোনাস শেয়ার দেওয়ার মতো রিটেইন আর্নিংস থাকতো না। যাতে করে নামমাত্র বোনাস শেয়ার ঘোষণার আড়ালে শেয়ার দর বাড়ানোর গেম্বলিংটাও সম্ভব হতো না।

দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাস শেষে (মার্চ ১৮) রিটেইন আর্নিংস ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার ৬১৩ টাকা। এই রিটেইন আর্নিংস নেগেটিভ হয়ে যেত, যদি লোকসান কমিয়ে না দেখাতো। ওই অর্থবছরের ১ম ৩টি প্রান্তিকের মতো শেষ প্রান্তিকেও যদি ১৫ পয়সা লোকসান দেখাতো, তাহলে বছর শেষে এই রিটেইন আর্নিংস নেমে আসত ৬৪ লাখ ৩৮ হাজারে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একইধারায় বা যৌক্তিক লোকসান দেখালে ওই রিটেইন আর্নিংস নেগেটিভ হয়ে যেত। যাতে করে ১ শতাংশ হারে ৪২ লাখ ৯২ হাজার টাকার বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করা সম্ভব হতো না।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাসের তুলনায় পুরো বছরে লোকসান কমে আসার কারন কি জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস.এম নুরুল ইসলাম বলেন, এটা ওপেন রিপ্লাই দেওয়া মুশকিল। এগুলাতো নিরীক্ষক ও অ্যাকাউন্টসের লোকজন যাচাই-বাছাই করে দাঁড় করায়। এখন এ বিষয়ে আমার পক্ষে বিস্তারিত বলা কঠিন। এখন বন্ধ থাকলে যা হয়, ফিক্সড খরচটাতো রয়ে গেলো। এছাড়া চিটাংগাং থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আসার সময় সকলের দেনা পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে আসছিলাম। তারপরে ঢাকাতে এসে কিছু লোকজন নিয়োগ দিয়েছিলাম। তারা বছরখানিক ছিল। এরপরে তারা আবার বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। এখন সীমিত কিছু লোকজন আছে। যাদেরকে ছাড়া যাচ্ছে না। তারা প্রতিযোগী কোম্পানির কাছে গেলে আমাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে।

তিনি বলেন, উৎপাদন চালু করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। তবে বড় সমস্যা হয়েছে ফান্ড নিয়ে। এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারলে দ্রুত উৎপাদন চালু করতে পারতাম। কিন্তু ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে বড় বাধা হচ্ছে, আইসিবির মনোনিত পরিচালকেরা যতক্ষন পর্যন্ত রাজি না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত নেওয়া যাবে না। এখন আইসিবি তাদের শেয়ারটা ট্রান্সফার করে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও কিছু আইনগত জটিলতা আছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এজিএমটা হয়ে গেলে অনেকটাই সমাধান হবে।

বিজনেস আওয়ার/১৯ আগস্ট, ২০২০/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: